Header Ads

ছোট ছেলে

মুরুব্বীরা সবসময়ই বলে এসেছেন, পরিবারের ছোট ছেলেটা একটু বেশিই দুষ্টু হয়। আবার অনেকেরই মতে পরিবারের ছোট ছেলেটা দুষ্টু তো বটেই, তবে বয়সের তুলনায় একটু বেশিই পরিপক্ব। হয়তো "অকালপক্বতা" শব্দটি রচিত হয়েছে পরিবারের ছোট ছেলেটাকে উল্লেখ করতেই।
মুরুব্বীদের উক্তিতে ছোট ছেলে হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মাননা পাওয়ার অধিকার রাখে আবির। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া চার ভাই এক বোনের পরিবারে ছোট ছেলেটার নামই আবির। দুষ্টুমির সনদে সে শতভাগ মান অর্জনকারী হলেও পরিপক্বতার সনদে শতভাগ মান পাড়ি দিয়েছে বয়সের তুলনায়।
.
আবিরের মতো পরিবারের ছোট ছেলে হলে হয়তো সবার অনেক আদর পাওয়া যায়, তবে শাসন যে পায়না এমন নয়। কখনো কখনো এমন দোটানায়ও পড়তে হয় যে, বড়দের কার কথাকে বেশি গুরুত্ব দিবে! কাকে সঠিক মানবে সেটা বুঝে উঠতে ভুলও হয়ে যায় অনেকসময়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আবিরের মতো পরিবারের ছোট ছেলেটার উপর পরিবারের অন্যসবার আশা-আকাঙ্ক্ষাটা একটু বেশিই থাকে। হয়তো তাকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন পরিবারের অন্যদের, "আবির একদিন অনেক ভালো ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবে।"
.
ছোট ভাইকে ডাক্তারি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হয়তো সর্বোচ্চ সাহায্যও করে পরিবারের বড়রা। এক্ষেত্রে বেশিরভাগই ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দায়িত্বটা চাপিয়ে দেয়া হয় পরিবারের ছোট ছেলেটার উপর। বড় ভাই-বোনের আদর আর ভালোবাসার বিনিময়ে নিজের দুয়েকটা ভিন্ন স্বপ্ন থাকলেও সেগুলোকে ভুলে বড়দের স্বপ্ন পূরণে ছুটতে চেষ্টা করে পরিবারের ছোট ছেলেটা।
আবিরের জীবনেও প্রতিনিয়ত এমনটাই ঘটছে। হয়তো ভুলটা কারোরই নয়। বড়দের অসীম ভালোবাসার বিনিময়ে আবিরের মতো ছোটদের এইটুকু তো করাই উচিত।
.
ফলাফল ভালো হলে সবার অনেক ভালোবাসা পাওয়া যায়, তবে পরিবারের ছোট হলে বেড়ে যায় আরো উচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার দায়িত্ব। এসএসসি ও এইচএসসিতে আবিরের ভালো ফলাফলটা যেনো এমনটাই প্রকাশ করলো। অতঃপর বড়দের ইচ্ছাতেই সরকারী মেডিক্যালে কিংবা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ্য পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় আবিরকে। সরকারী থেকে পা পিছলালেও বড়দের স্বপ্ন পূরণে ভালো কোন বেসরকারি প্রকেতিষ্ঠানকে আলিঙ্গন করতে হয়। তখন প্রায় অনেকেই বলে, "পরিবারের ছোট ছেলে তো, তাই আয়েশ করে নাম ফোটানোর জন্য ঐ ভার্সিটিতে পড়ছে।"
.
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যেই পথ চলা শুরু হয় আবিরের। তখনও আবিরের জীবন জুড়ে ছিলোনা কোন বালিকার ভালোবাসা। প্রথম পর্বের কয়েকটাদিন চলে যায় সবার সাথে পরিচিত হতে, তবে তারপর থেকেই শুরু হয় দুষ্টু আবিরের আগের সেই দুষ্টুমি। দুষ্টুমির সাথে একটু পড়াশুনা, সবার চোখেই ভালো ছাত্র আবির। এভাবেই অতিবাহিত হয়ে যায় প্রথম পর্ব।
.
পর্ববিরতিতে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যায় আবির। কয়েকদিনের জন্য গ্রামে ফিরলেও দুষ্টুমিটা আগের মতই। আগের মতো করেই অতিক্রম হচ্ছিলো আবিরের ছুটির দিনগুলো। তবে বিভিন্ন লোকের এমন কথা প্রায়ই শুনতে হয়, "পরিবারের ছোট ছেলে তো, তাই কোন দায়িত্ব নেই। নাম ফোটানোর জন্যই এমন ভার্সিটিতে পড়তে পারছিস।"
আবির কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারেনা, কারণ সারাজীবন বললেও আমাদের সমাজের এই ধারণা পরিবর্তন হবেনা। বাস্তবতাটা থেকেই যাবে সবার অন্তরালে।
.
ছুটির প্রায় শেষ সময়ে এসে একটা দিনকে পুঁজি করেই ছুটলো মামা বাড়ি। মামা বাড়ি গিয়ে আগের মতো করেই দুষ্টুমিতে মাতিয়ে তুলছিল, সাথে ছিলো দুই কাজিন সিয়াম এবং আয়েশা। তখনই আয়েশার এক বান্ধবী আয়েশার সাথে দেখা করতে এবং হোস্টেলে কবে যাবে সে বিষয়ে আলাপ করতে আসে। মেয়েটা আয়েশার হোস্টেল রুমমেট, পাশের এলাকায় বাড়ি। অতিরিক্ত লজ্জাবতী এবং স্বল্পভাষী হওয়ায় আবিরের দুষ্টুমিকে পাত্তাই দিলোনা মেয়েটা। এমনকি আবিরের দিকে ফিরেও তাকায়নি একবারও। তবে থেমে থাকেনি আবির, বরং দুষ্টুমির মাত্রাটা বাড়িয়েই দিলো। মেয়েটা যেটুকু সময় ছিলো, পুরো সময়টা জুড়েই আবিরের দুষ্টুমির যন্ত্রণায় কিংবা ভিন্ন কোন লজ্জায় পড়তে হয়েছে তাকে। অতঃপর চলে যায় মেয়েটা, আবিরও ফিরে সন্ধ্যে নামার পূর্বে।
.
দ্বিতীয় পর্ব শুরু করতে পরদিন সকালে পাড়ি জমায় শিক্ষানগরীর উদ্দেশ্যে। দুদিন কেটেও যায় ভালো ভাবেই। তবে আয়েশার সেই লজ্জাবতী বান্ধবীর লজ্জাময় মিষ্টি হাসি এবং অসম্ভব মায়া ভরা চোখের কথা ভুলতেই পারেনি। আয়েশার থেকে তার বান্ধবীর সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে অনেকটা সাহস পায় আবির। কেননা মেয়েটার চারিত্রিক পটভূমি অনেক সুন্দর। সুন্দর তার নামটাও, জান্নাত!
আয়েশার থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে অনেকদিন ধরে চেষ্টাও করে আবির। কিন্তু জান্নাতের এসব পছন্দ না হওয়ার ছলে এড়িয়ে যায় বারবারই। জান্নাত প্রতিবারই বলছে, "আমি বাবা-মা, ভাইয়াদেরকে কষ্ট দিতে পারবো না।"
.
বিরক্তির প্রায় একমাস পরেই আবির তার মনের কথাগুলো জান্নাতকে জানিয়ে দেয়, "আমার খুব ইচ্ছে একটা মেয়েকে পাগলের মতো ভালবাসবো। তোমার সাথে কথা বলে কিংবা তোমার সম্পর্কে সম্পূর্ণটা জেনে মনে হলো তুমিই এর জন্য সুযোগ্য। সবচেয়ে বড় কথা হলো তোমার সবকিছুই আমার ভালো লাগে। আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতে চাই আজীবন। না না, বিনিময়ে তোমার ভালোবাসা চাইনা। শুধু একটু কথা বললেই হবে।"
আবিরের এই পাগলামো প্রস্তাবে জান্নাত কোন সায় দেয়নি, তবে মাঝে মাঝে দুএক মিনিট কথা বলবে এমন বাণীতেই খুশি করে আবিরকে।
.
ভালোবাসার ছলে না হলেও প্রতিদিন দুয়েক মিনিট কথা হতো আবির-জান্নাতের। তবে জান্নাতের একটা অনুরোধ ছিলো যেনো পবিত্রতা রক্ষা করেই কথা বলে। জান্নাতের সাথে আবিরের তিন মিনিট কথা হলে দুমিনিটই কাটতো নামায পড়া কিংবা অন্য ভালো কাজ গুলো করার অনুরোধ শুনতে। আবির সবসময়ই জান্নাতের কথা মানতে চেষ্টা করতো। এভাবে তিনমাস কেটে যাওয়ার পর দেখা গেলো আবির নামের দুষ্টু ছেলেটা অনেকটাই পরিণত। দুষ্টু আবিরের দুষ্টুমি আর পাগলামি, দুটোই বর্ধিত হয়ে গেছে। তবে আবিরের জীবনে জান্নাতের গুরুত্ব ছিলো আগের মতোই।
.
আবিরের অসীম পরিবর্তনেও ভালোবাসায় গুরুত্ব একই রকম ছিলো বলে অনেকটা অবাক হয় জান্নাত। কেনোনা, এমন করে খুব কম মানুষই কাউকে ভালোবাসতে পারে। ততদিনে অবশ্য জান্নাতের মনেও ভালোবাসার মায়া জমে যায় আবিরের প্রতি। অতঃপর কোন একদিন জান্নাত তার মনের কথাগুলো জানালে আবির যেনো বর্ষের তৃতীয় ঈদ পালন করতে শুরু করে। জান্নাতের মতো একজন মহীয়সীর ভালোবাসা পাওয়া অনেকটা বছরে তৃতীয় ঈদ পাওয়ার মতোই। তবে জান্নাতের অনুরোধ ছিলো যেনো ভালোবাসায় সম্পূর্ণ পবিত্রতা বজায় রাখে।
.
পবিত্রতা রক্ষা করেই ভালোবাসার পথ ধরে কেটে যায় দুবছর। আবির তখন পঞ্চম পর্ব পাড়ি দিয়েছে মাত্র। তখনই জান্নাতের জন্য অনেকদিন ধরে ভালো ছেলে খুঁজতে থাকা বড় ভাই একটা ভালো ছেলের খোঁজ পায়। এরপর বিয়ে ঠেকাতে জান্নাত অনেক ভয়ে ভয়েও আবিরের কথা জানায় তার ভাইয়াকে। অতঃপর আবিরের সম্পর্কে যাবতীয় খোঁজ নিয়ে আবিরকে একদিন ডেকে পাঠায় জান্নাতের ভাইয়া।
.
আবিরকে সামনে বসিয়ে জান্নাতের ভাইয়া একাধারেই বলতে থাকে, "আবির, চার ভাই এক বোনের পরিবারে ছোট ছেলে। বড় ভাই ছাড়া আর কেউই বিয়ে করেনি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিএসসি পড়ছো বড় ভাইদের সাহায্যকৃত টাকায়। বিএসসি শেষ করতে এখনো মোটামুটি দুবছর বাকি। ধরলাম বিএসসি শেষ করার পর একটা চাকরি নিতে পারবে চলার মতো, তবুও কি পারবে বিয়ে করতে? তোমার বড় দুইটা ভাই এখনো অবিবাহিত, একমাত্র বোনকেও বিয়ে দিতে হবে। তুমি কি পারবে এইসব কিছুর আগে জান্নাতকে বউ করতে? তোমার এই সবকিছু কাটিয়ে উঠতে, ভালো কোন চাকরি পেতে কম করে হলেও পাঁচ বছর সময় লাগবে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কোন ভাই এতো সময় ভরসা করবেনা পরিবারের কোন ছোট ছেলের উপর। আমিও তো চাই আমার বোনটা সুখে থাকুক। হয়তো এটাও ঠিক যে আমার বোন তোমার সাথেই সুখী হতো। কিন্তু তোমার হাতে বোনকে যে তুলে দিবো, তোমার সেই হাতটাই তো এখনো তৈরি হয়নি। তাছাড়া তুমি পরিবারের ছোট ছেলে, পরিবারের কোন দায়িত্বই নিতে শিখোনি তুমি। আমি কি করে এইরকম একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলের কাছে আমার আদরের একমাত্র ছোটবোনকে তুলে দিব? তাছাড়া উদয় ছেলেটা অনেক ভালো, তার হাতে আমার বোনকে তুলে দিলে হয়তো অনেক সুখী হবে আমার বোন। সেটা চাওয়া কি আমার দোষ হবে?"
.
জান্নাতের ভাইয়ার কথাগুলো শুনতে শুনতেই কেঁদে ফেলেছে আবির। অশ্রু ঝরছে অঝোরে। বাস্তবতার কাছে হেরে গেছে তার উজাড় করা ভালোবাসা। পরিবারের ছোট ছেলে হওয়ায় নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। জান্নাতও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে অন্যপাশে। জান্নাতের ভাইয়ের চোখেও জল ঝরছে বেশ। তাকে দোষ দেয়াটাও ভুল হবে, কেননা বড়ভাই হিসেবে বোনের সুখ কামনা করার অধিকার তার রয়েছে। হয়তো তার ধারণা দুদিন পরে হলেও উদয়ের কাছেই সুখে থাকবে জান্নাত।
.
আবির পারছেনা কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে। পরিবারে কেউই তার ভালোবাসার পক্ষে নেই। কেনোনা তাকে অনেক দূর যেতে হবে। সবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। কারো স্বপ্ন ভাঙ্গার অধিকার তার নেই। পালিয়ে বিয়ে করলে কি পারবে জান্নাতকে সুখী করতে কিংবা পরিবারের স্বপ্ন পুরণ করতে!
অতঃপর আবিরের উজাড় করা ভালোবাসার মৃত্যু ঘটিয়ে বিয়ে হয়ে যায় জান্নাতের। বিয়ের আগ মুহূর্তে আবিরকে "ভালো থেকো" টেক্সট করেছিলো জান্নাত। তবে স্বামীর বাড়ি যাওয়ার পর থেকে জান্নাত আর কখনো খোঁজ নেয়নি আবিরের। হয়তো জান্নাত যে অনেক ভালো মেয়ে, তার প্রমাণই ছিলো এটা।
.
বিয়ের প্রায় তিনমাস পার হয়ে গেছে, জান্নাতও নাকি ভালোই আছে। তবে জান্নাতকে ভুলতে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ আবির। তাই জান্নাতকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেই পরিবারের স্বপ্ন পূরণে অগ্রসর হতে থাকলো। বসে বসে এসবই ভাবছে আবির, হঠাৎই একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসলে রিসিভ করে আবির। কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো করার পর বুঝতে পারলো ফোনের ওপাশে কেউ কাঁদছে। বুঝতে বাকি রইলোনা আবিরের। দু প্রান্তেই চুপ প্রায় তিন মিনিট, তবে ভেসে বেড়াচ্ছে কান্নার শব্দ। হঠাৎই কান্না কান্না গলায় ওপাশ থেকে, "আবির আমি জানতাম না আমি তোমাকে এতো বেশি ভালোবাসি। তাহলে ভাইয়ার হাতে পায়ে ধরে হলেও তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। ভেবেছিলাম তোমাকে হয়তো ভুলে যাবো কথা না হলে। কিন্তু আমি যে সেটা পারিনি। তুমি পরিবারের ছোট ছেলে কেনো হলে?"
কথাটা বলেই আবার কান্না শুরু করে জান্নাত। আবিরও অঝোরে অশ্রু ফলাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই ভালো থাকার নিমন্ত্রণ জানিয়ে ফোনটা কেটে দেয় জান্নাত। অশ্রুরত অবস্থায়ই আবিরের আর্তনাদ, "ছোট ছেলে কেনো হলাম?"
আবিরের প্রতিচ্ছবি আবিরকে বলছে, তুমি দুষ্টুমি করতে পারবে ইচ্ছেমতো, কিন্তু কাউকে ভালোবাসার অধিকার তোমার নেই। কারন তুমি পরিবারের ছোট ছেলে।
.
রিয়াদ হোসাইন রিমন

No comments

Powered by Blogger.