দ্যা পর্নো

হোয়াটসঅ্যাপে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে। তাতে বিশেষ কিছু লেখা নেই, শুধুই একটা পর্ণো ওয়েবসাইটের লিংক দেয়া। লিংকে ক্লিক না করেই বিষয়টা বুঝা যাচ্ছে। তবে কোনো হ্যাকারের পাঠানো ফিশিং লিংকও হতে পারে। একটা টোপ। ক্লিক করলেই কেল্লা ফতেহ্। ফোনের যাবতীয় ডেটা, সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাক্সেস, সব চলে যাবে ওদের হাতে।
তবুও মানুষ অতিআগ্রহী জীব!
নতুন ল্যাপটপ। খুব বেশি কোনো ফাইল নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় কানেক্টেডও না। ওখান থেকে লিংকে গেলাম।
না। লিংকটা কোনো ফিশিং সাইটের না, পর্ণো ওয়েবসাইটেরই। একটা ভিডিও ওপেন হয়ে চলতে শুরু করলো সাথে সাথে। আমি স্তম্ভিত চোখে দেখছি, ভিডিওতে যে মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে ওর নাম রণক, আমার প্রেমিকা।

রণক আর আমার সম্পর্ক সাত বছরের। এতটা সময় খুব সহজে কাটেনি। অনেক ঝড়ঝাপটা এসেছে। অনেক ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। কিন্তু দিন শেষে সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে সবসময়।
ঝগড়া মিটে গেলে ও সবসময় শান্ত কণ্ঠে বলেছে, একা একা ঝগড়া করা যায়? তুমিও একটু ঝগড়া করতে পারো না? একটু অবিশ্বাস করতে পারো না? শুধু ভালোবাসলেই হয়?
আমি হেসে উত্তর করি, শুধু ভালোবাসলেই হয়।

আমার বিশ্বাস আমি একজন অতি পজেটিভ মাইন্ডেড মানুষ। কিন্তু আজ আমার বিশ্বাস নড়বড় করছে। এখন একটা ফোন করে রণককে সব জিজ্ঞেস করলে হয়তো জবাবদিহিতা হবে, বিশ্বাসের পুনরুত্থান হবে কি?

ফোনে রিং পড়ছে। ওপাশ থেকে জুয়েল দা কল ধরলো।
হ্যালো। কী রে, কী খবর?
খবর তেমন কিছু না। আমার প্রতি বিশ্বাস রেখে একটা কাজ করবে, জুয়েল দা?
এমন করে বলছিস কেন? কী কাজ বল। কার আইডি খেতে হবে?
কারও আইডি খেতে হবে না। শুধু একটা ভিডিও ইন্টারনেট থেকে সাফ করে দিতে হবে। তোমার যত টাকা লাগবে তা দিতেও রাজি আছি।

জুয়েল দা আমার মাসতুতো ভাই। তবে চেহারায়, কিংবা ঘনিষ্ঠতায় আমাদের আপন ভাই বলেই যে কেউ মনে করতে বাধ্য। দেখতে আমরা দুজনই প্রায় একই চেহারার। বয়সের পার্থক্য মাত্র ৭ মাসের। বর্তমানে ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে। শুধু তা ই নয়, হ্যাকিং জগতে ওর মতো অসাধারণ আর কাউকে আমি দেখিনি।
জুয়েল দা বেশ চমকে গেল আমার কথায়। একটু থমকে বলল:
কী রে পার্থ, কী হয়েছে বল!
হোয়াটসঅ্যাপে একটা লিংক এসেছে...
ফিশিং?
না। ফিশিং না। পর্ণো ওয়েবসাইট লিংক।
পর্ণো!
হ্যাঁ, একটা ভিডিও...
কার!
রণকের।
হোয়াট??

প্রায় ৬ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। হোয়াটসঅ্যাপে যে নম্বর থেকে মেসেজ এসেছিল তা শরিয়তপুরের কোনো গ্রামের এক প্রাইমারি স্কুল টিচারের নামে রেজিস্টার করা। সিমকার্ড ক্লোন করা এখন খুবই সহজ ব্যাপার। স্কুল টিচারের নম্বর ক্লোন করে যে মোবাইলে তা এন্টার করিয়ে আমার হোয়াটসঅ্যাপে লিংকটা পাঠানো হয়েছে, সে মোবাইলের আইপি এড্রেসও উদ্ধার করা গেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
আইপি ট্র্যাক করে মোবাইলটা একজন রিক্সাওয়ালার কাছে পাওয়া গেছে। সে মোবাইলটা খুঁজে পেয়েছে মুরাদপুর এলাকায়। যেখানে ওটা পাওয়া গেছে, সে রাস্তায় অবশ্য সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। ক্যামেরার ফুটেজ চেকিং হচ্ছে।

মোট ২৭ টা পর্ণো ওয়েবসাইটে ভিডিওটা আপলোড হয়েছে। আনপেইড ভিপিএন ব্যবহার করায় সে সময়ে এক্সেস করা সব ওয়েবসাইট খুঁজে পাওয়া গেছে সহজেই। জুয়েল দা এর মধ্যেই সবগুলো ওয়েবসাইট থেকে ভিডিওটা সরিয়ে দিয়েছে অনায়াসে।
তবে মূল ভিডিও ফাইলটা অবশ্যই সে ব্যক্তির কাছে স্টোর করা আছে, এবং ঐ ব্যক্তি যে খুব একটা সহজ কেউ না, তা বুঝতে বাকি নেই।
যে সে হলে এতক্ষণে কোনো না কোনো উপায়ে সন্ধান পাওয়া যেতই। কিন্তু খুব সুচারুভাবে পরিকল্পনা করেই প্রত্যেকটা কাজ সে করেছে।

জুয়েল দা বলল, রণককে জিজ্ঞেস করলেই সহজ হয়ে যায় না?
না।
কেন?
কেউ আমার কাছে যে কারণে লিংকটা মেসেজ করেছে, তা সফল হয়ে যাবে। কোনো ক্লু পেলে?
না। চেষ্টা করছি। জানাবো।

তক্ষুণিই রণকের ফোন। ও কি কিছু জেনে গেছে? ওর কাছে অবধিও কি এসব পৌঁছে গেছে? রণক কি আমায় নিজে থেকেই জানিয়ে দেবে সবকিছু? মেয়েরা তো কনফেস করতে পারে না। কিন্তু এত বাজে সিচ্যুয়েশনে এসে রণক কী করবে? আমার কি ওর প্রতি ঘৃণা জন্মাবে?
ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে, অথচ ডিসপ্লেতে তাকিয়ে আমি উদ্ভট সব কল্পনা করেই যাচ্ছি।
কল রিসিভ করলাম, হ্যালো রণক, বলো।
একটা মানুষ এভাবেও ভুলে যেতে পারে?
কোন ভাবে?
এই যে, সকাল থেকে একটা কল নেই, মেসেজ নেই। সারাদিন থাকো কই?
কই থাকবো?

প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন হয়ে যাচ্ছে বারবার। বিষয়টা রণকের পছন্দ না। এখনই রেগে যাবে হুট করে।
তোমার কাছে জানতে চাইলাম। তুমি পাল্টা প্রশ্নই করে যাচ্ছ কেন? কী সমস্যা তোমার? এমনিতেই কোনো খোঁজ খবর রাখো না, শুধু প্রেম করো বললেই হয়? ভালোবাসি ভালোবাসি মুখে বলার বিষয় না। কাজেও করে দেখাতে হয়। কেয়ার করতে হয়। যত্ন করলেই বুঝা যায়। তুমি করো? যত্ন করো একটুও?...
রণক আমি কথা বলার জন্য একটুও সময় ছাড় দিচ্ছে না। আমি এ পাশ থেকে মুখ হাসি হাসি করে আছি। তা অবশ্য রণক দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তবুও ও জানার কথা। এত বছর সম্পর্কে এটুকু অজানা থাকে না।

জুয়েল দা ফোন করেছে আবার। আমায় ওয়েটিংয়ে পাচ্ছে। এদিকে রণক বকাবকি করছে। এখন কল কেটে দিলে ওর ভয়ানক রাগ হবে। কিন্তু জুয়েল দা'র কল রিসিভ করা দ্য মোস্ট আর্জেন্ট...
হ্যালো, বলো।
যাবিদ হাসনাত নামে কাউকে চিনিস?
আমি এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ কেন বলোতো?
ভিডিওটায় যে ছেলেটার ফেস দেখা যাচ্ছে না, ও যাবিদ। ওর সাথে রণকের কী সম্পর্ক?
ওরা ক্লাসমেট।

দুজনই হয়তো বিষয়টায় একটু অস্বস্তিকর অবস্থায় এসে পৌঁছে গেছি। প্রচণ্ড হতাশ কণ্ঠে জুয়েল দা বলল, কী করবি?
যাবিদকে একটা ফোন করবো।
তুই বললে দুটোকে তুলে এনে ঠ্যাঙ ভেঙে দিই?
আরে না। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবো।
যাবিদ এটা ভিডিও করলো, তারপর নেটে দিলো, আবার আমার কাছে লিংক পাঠালো। লিংক পাঠানোর সব ইনফো মুছে দেয়ারও চেষ্টা করলো। প্রথমত, ও আমার কাছে কেনই বা পাঠাবে? আর এতটা টেকএক্সপার্ট ও হবে বলে মনে হয় না আমার।
আমি একটা কথা বলবো পার্থ?
কী কথা?
সব বাদ দে। অনেক হয়েছে। এ সম্পর্ক রাখার কোনো মানেই হয় না।
যেটা কেউ একজন বা দুজন মিলেই ভাঙে, তা কোনো সম্পর্ক হয় না জুয়েল দা। তা হয় কোনো চুক্তি। আমি তো চুক্তি করিনি। সম্পর্ক তৈরি হয় নিজে নিজেই। আর ভাঙন যদি হয়, তাও আপনিই হয়ে যাবে। চেষ্টা করেও ভাঙন আটকানো যাবে না।
আর তোর সাথে যে চিট হলো?
কই চিট হলো?
আশ্চর্য ভাই, এইটা তোর চিট মনে হচ্ছে না?

আমি হাসলাম। হেসে বললাম, ওসব পরে ভাববো। এখন রণককে তো সমস্যাটা থেকে উদ্ধার করা লাগবে। তাই না?
তোকে না বলে একটা কাজ করেছি।
কী কাজ? নিশ্চয় রণকের আইডি হ্যাক করেছ?
হুম।
থাক, ওসব বলে কাজ নেই। ভিডিওটা কে ছড়িয়েছে, আমার কাছে কোন উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছে -তাতে ফোকাস করো।
যাবিদের সাথে মেসেঞ্জারে কাল রাতেও রণক ঘনিষ্ট আলাপে...

থাক না!
আমি থামিয়ে দিলাম। রণক এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। ফোন করে আমায় ওয়েটিংয়ে পেয়েছে। ওকে কলব্যাক করলাম কয়েকবার। ও ফোন ধরলো না। অভিমান করেছে হয়তো। কিন্তু এখনো কি অভিমান ওর মনে আসে?

যাবিদকে ফোন করলাম। নম্বরটা মোবাইলের কনট্যাক্টসেই ছিল, হ্যালো, যাবিদ হাসনাত?
হ্যাঁ, কে বলছেন?
আমার নাম পার্থ সারথি পোদ্দার।
আরে পার্থ দা, কেমন আছেন?
ভালো। তুমি কেমন আছো?
ভালো আছি দাদা।
দুজনের কথা থেমে গেছে। আমি কী বলবো বুঝতে পারছি না, যাবিদ কী কারণে আমি কল দিয়েছি তা বুঝতে পারছে না। খাওয়া দাওয়া হয়েছে, যাবিদ?
হ্যাঁ দাদা। দুপুরে খেয়েছি। এখন তো প্রায় সন্ধ্যে। একটু পরে খাবো। আপনার খাওয়া দাওয়া হয়েছে?
হয়নি। তবুও অকারণে অবচেতনে মিথ্যে বললাম, হয়েছে।
তো দাদা, হঠাৎ কী মনে করে? না মানে কখনো তো ফোনে কথা হয়নি!
কিছু মনে করে না। তোমার সাথে আলাপ করা দরকার মনে হলো। তাই...
কী বিষয়ে?
কিছু না।

আমি কল রেখে দিলাম।
লজ্জা বিষয়টা খুব অদ্ভুত। কাউকে টাকা ধার দেয়া হলে যে ব্যক্তি টাকা ধার নেয়, সে ব্যক্তির চেয়ে বেশি লজ্জিত হতে থাকে যে ব্যক্তি টাকা ফেরত চাইতে চেষ্টা করে। যে ব্যক্তি ধর্ষণ করে, তারচেয়ে বেশি লজ্জিত হতে হয় যাকে ধর্ষণ করা হলো তাকে। সন্তান নেশাগ্রস্থ হলে সে সন্তানের কোনো লজ্জা হয় না, লজ্জিত হতে হয় ভুক্তভোগী পিতা মাতার।
আমার প্রেমিকার সাথে অদ্ভুতভাবে মেলামেশা করা ছেলেটাকেও আমি কঠিন কিছু বলতে পারলাম না।

কিছুক্ষণের মধ্যে রণক ফোন করলো, হ্যাঁ রণক, বলো।
যাবিদের কাছ থেকে আমার ফোন করার বিষয়টা জানতে পেরেই কি ও এত দ্রুত কলব্যাক করলো। সাধারণত ও রাগ করলে তা কমতে সময় লাগে। অতটা সময় আমি অপেক্ষা করি। তারপরও কথার ধরন স্বাভাবিক হতে সময় নেয়।
কই, কিছু বলছো না কেন?
রণক স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, কী করছো?
তোমার সেফটি নিয়ে ভাবছি।
রণক থমকে গেল একদম। কোথায় কী হচ্ছে সে বিষয়ে ওর কাছ অবধি এখনো কোনো খবর পৌঁছেনি। আমার সেফটি মানে? কী বলছো পার্থ?
হ্যাঁ। তোমার সেফটি।
কথাটা ক্লিয়ার করো পার্থ!
আমি কথা ক্লিয়ার করলাম না। বরং রেখে দিলাম। সি স্যুড কনফেস। তা না হলে আমার জন্য ওকে রক্ষা করা টাফ হয়ে যাবে!

একটা সিগারেট ধরালাম। সূর্য ডুবে গেছে অল্পক্ষণ আগে। তবুও আলোচ্ছটায় সারা আকাশ দেখা যাচ্ছে। এ বারান্দায় একবার আমি আর রণক বসেছিলাম। সেই একবারই ও আমার বাসায় এসেছে। বাবা বাসায় ছিলেন না। মায়ের সাথে পরিচিত হলো ও। দুজন বেশ জমিয়ে আড্ডা দিলো। আমি তেমন কোনো কথা না বলে শুধু ঘুরঘুর করছিলাম ওদের আশেপাশে। ওরা একসাথে রান্না করছিল; রেসিপি, সিরিয়াল, মুভি, শাড়ি এসব বিষয়ে আলাপ করছিল; আর আমি হাসিমুখে শুনছিলাম।
দুপুরবেলা এ বারান্দায় ও আর আমি বসে গান করছিলাম।
গিটারটা নিয়ে আজও বসেছি।
ভুপেন হাজারিকার গান, মেঘ থমথম করে...

জুয়েল দা'র কলে পকেটে থাকা মোবাইল ভাইব্রেট করছে, হ্যালো জুয়েল দা।
ছেলেটা আমার সামনে বসে আছে।
কোন ছেলে?
মিশুক।
মিশুক?
হ্যাঁ। রণকের আরেকজন ক্লাসমেট। প্রিতম, আলতাফ আর সবুজকেও ধরে আনা হচ্ছে কিছু সময়ের মধ্যে। তারপর যাবিদ হাসনাত...
কী বলছো এসব?
ইমেইল শেষ কবে চেক করেছিলি?
দেরী হয়েছে। কেন?
চেক কর। ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

জিমেইলবক্সে এ সংক্রান্ত কোনো মেইল আসেনি। তবে স্প্যামবক্সে গিয়ে পাওয়া গেল। দশ দিন আগের একটা মেইল। সে মেইলে যা লেখা আছে তা সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়,
রণকের গোপন ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়া হবে। যদি তা না চাই, তাহলে দশ লক্ষ টাকা দিতে হবে। প্রথমে দশ দিন সময় দেয়া হলো। টাকা দিতে রাজি না হলে ভিডিওটা পর্ণো ওয়েবসাইটে যাবে। তাও রাজি না হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাবে।

আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে শেষ করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে এক এক করে সবাই আটক হলো। হয়তো কালকে সকালের পত্রিকায় নিউজ হতে যাচ্ছে, একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে গোপন ছবি ও ভিডিও বন্ধুদের মধ্যে আদান প্রদান এবং পরবর্তীতে ভিডিও ভাইরালের হুমকি দিয়ে দশ লক্ষ টাকা আদায়ের চেষ্টা।
আর এ সব কিছুর ভেতরে যাকে সবচেয়ে বিব্রত হতে হবে, সে হচ্ছে রণক।
এ সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকবার রণক ফোন করেছে। আমি রিসিভ করিনি। ওর সাথে কথা বললে বিষয়গুলো এতটা স্মুথলি করতে পারতাম না। তখন ওর ফোন থেকে একটা মেসেজও এসেছে, পার্থ, আমার কিছু বলার আছে, প্লিজ। শেষবার।

জুয়েল দা'কে একটা কল করা দরকার।
হ্যালো
হ্যাঁ পার্থ। ওদের সবার ব্যবহার করা ফোন, ল্যাপটপসহ সব ডিভাইস পুলিশের আন্ডারে এসে গেছে। আশা করি কোনো সমস্যা আর হবে না।
মিডিয়া, কোর্টকেস ওসব তো হবে?
ওসব না হলে এদেরকে ছাড়তে হবে। আর শোন, তুই একবার থানায় চলে আয়।
কেন?
রণক আর ওর বাবা বসে আছে। প্রসিডিওরগুলো কমপ্লিট করতে হবে।
আচ্ছা।
একটা বিষয় জানলে অবাক হবি...
কী বিষয়?
ওদের টার্গেট রণকের বাবাও ছিলেন। উনিও তোর মতো মেইল চেক করেননি, এমনকি মেসেজও দেখেননি। অনেকগুলো মামলা পড়তে যাচ্ছে ওদের উপর...
রণক ঠিক আছে?
জুয়েল দা উত্তর না করে বলল, আয় তুই, তারপর কথা।

আমি বের হলাম। কিন্তু থানার দিকে যাচ্ছি না। যাচ্ছি কর্ণফুলির দিকে। এখন ঘড়িতে সময় ৮ টা ১৫। রাতের নদীর বেশ কিছু ক্ষমতা আছে। সেসব ক্ষমতার একটা হলো কথা বলা। রাতের নদী কথা বলে মানুষের সাথে। তাদের দুঃখ নিয়ে আলোচনা করে।
কী খবর নদী, কেমন আছ?
কলকল কলকল।
আমিও ভালো আছি। কিছু খেয়েছ?
কলকল কলকল।
হ্যাঁ আমি জানি প্রশ্নটা বোকার মতো হয়েছে। নদীরা তো কিছু খায় না। আচ্ছা, তুমি কাউকে ভালোবাসো?
কলকল কলকল।
সবাইকে বাসো? সবাইকে ভালোবাসা যায় নাকি? আচ্ছা, আমার কথা বলি। আমি রণককে অনেক ভালোবাসি। তুমি তো জানো সব।
কলকল কলকল।
কী বললে? ভালোবাসলে সব মাফ? কেন? অমন কেন?
কলকল কলকল।
হ্যাঁ। ঠিক বলেছ। কেউ যদি ভালো না বাসতে পারে তবে তা তার ব্যর্থতা। ভালোবাসতে যে পারে, তার কখনো যে ভালোবাসতে পারেনি, তার জন্য কষ্ট পেতে নেই। কিন্তু কষ্ট যে হচ্ছে?
কলকল কলকল।
রণক খুব বোকা? তাই ও ছেলেটা অমন ভুলিয়ে ফেলেছে?
কলকল কলকল।
আমি এখন কী করবো বলতে পারো?
কলকল কলকল।
রণকের উপরই ছেড়ে দেবো? ও যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাই করবো? কিন্তু বিশ্বাস কি করতে পারবো?
কলকল কলকল।
হ্যাঁ ঠিক বলেছ। মানুষ বিশ্বাস ভাঙে বলেই বিশ্বাস করে তা ভাঙতে দিতে হয়। বিশ্বাস রাখাটা স্বাভাবিক হয়ে গেলে বিষয়টা এত গুরুত্ব পেত না।

পকেটে মোবাইলের ভাইব্রেশন হতেই নদীর সাথে আলাপ থেমে গেল। রাত ১১ টা বেজে গেছে কবে? কলটা রিসিভ করলাম।
হ্যালো জুয়েল দা।
তুই থানায় এলি না কেন?
এমনি।
তুই কিছু কি জেনেছিস?
কী জানবো?
তোকে ও সময় মিথ্যে বলেছি। ওসময় রণক আসেনি। শুধু ওর বাবা এসেছে।
জানি।
জানিস মানে?
ঘটনাটা কখন ঘটেছে?
তুই থানায় আয়, কথা বলবো।
আসামী সব গ্রেফতার?
হ্যাঁ।
এবারে তো মার্ডার চার্জ লাগবে ওদের উপর, তাই না?
তুই কোথায়?

আমি ফোন রেখে দিলাম। একবার চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিতেই টের পেলাম, আমার পাশে এসে কেউ বসেছে।
রণক?
হুম।
কেন করলে এমন?
জানি না। মানুষ বেঁচে থাকা সময়ে অনেক কিছুই করে। এসব কিছুর কারণ মৃত্যুর পরও বুঝে উঠতে পারে না।
ভালোবাসতে আমায়?
তুমি বাসতে। আমি হয়তো ভালোবাসার মতো মনটুকু তৈরি করতেই পারিনি।
আমি বাসতাম, তা কী করে জানলে?
অকারণে কারও সব কথা শুনবে, সব চাওয়া পূরণের চেষ্টা করবে, সব সময় পাশে থাকতে চাইবে -এমন মানুষ তো সবাই হয় না। লক্ষ-কোটিতে একজন হয়।
তবে অনবরত ভুল করতেই থাকলে কেন?
এ কারণটুকু তো আমার জানা নেই, পার্থ।

আমি চোখ মেললাম। রণক কোথাও নেই। নদী কলকল করছে। জোয়ারের তোড়ে ভাসানো মটর নৌকার শব্দ বাতাসে ভেসে আসছে দূরে কোথাও থেকে।
নদী?
কলকল কলকল।
আমি কাজটা ভালো করেছি না?
কলকল কলকল।
হুম। আমার সাথে সম্পর্ক ভেঙে চলে গেলেও কিছু বলতাম না। আমায় কিচ্ছু না জানিয়ে এত ঘনিষ্ঠতা দিনের পর দিন। সবাইকে সরিয়ে দিলাম।
কলকল কলকল।
হ্যাঁ, আমি জানি। রণক আরেকটু অপেক্ষা করলে ওকে ফিরিয়ে আনতে পারতাম। তাই না বল?
কলকল কলকল।

অভিষেক দেবনাথ অভ্র