Header Ads

প্রাক্তন

তিন বছর দুই মাস পর হঠাৎ প্রাক্তনের ফোন কল। আমি
কনফারেন্স টা হোল্ড করে বাইরে এসে ফোন রিসিভ
করি।
মনের ভেতর চাপা একটা রাগ আর একগাদা অভিমান
ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
-- কেনো ফোন দিছেন?
-- কেমন আছো?
-- প্রচন্ড ভালো থাকা বুঝেন? আমি প্রচন্ড ভালো আছি।
-- ওহ। তো…
-- তো কি? তাড়াতাড়ি বলেন, আমি অফিসের কাজে
ব্যস্ত আছি।
-- ওহ, স্যরি। তোমার কাজে ডিস্টার্ব করলাম। রাখছি।
-- ফোন দেয়ার কারন টা বললে খুশি হতাম।
-- এমনিই। তেমন কিছুনা।
-- ওহ আচ্ছা।
-- ফ্রি হয়ে কল দিতে পারবা? কিছু জরুরী কথা ছিলো।
ব্রেকাপের তিন বছরেরও বেশি সময় পর আমার সাথে
রাইসার কি জরুরী কথা থাকতে পারে সেটা মাথায়
আসতেছিলোনা। ভাবনাটা বাদ দিতে চাইলাম।
কনফারেন্স রুমে ঢুকে সবাইকে স্যরি বলে মিটিং শুরু
করলাম আবার। কিন্তু কেনো জানি তিন বছরেরও বেশি
সময় পরে আজকে রাইসার কথা আমাকে ভাবাচ্ছে খুব।
মিটিং এ কনসেন্ট্রেট করতে পারছিনা। কোনভাবে
মিটিং শেষ করে আমার চেম্বারে গিয়ে রাইসার
নাম্বারে ডায়াল করলাম। ওয়েটিং এ আছে। একসময়
ফোন ওয়েটিং এ থাকা নিয়ে অনেক ঝগড়া হতো
আমাদের মাঝে। কিন্তু আজকে ব্যাপার টা আমার কাছে
স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে।
মিনিট পাচেক পর ও নিজেই কল দিলো।
-- ফ্রি আছো?
-- হ্যা, বলেন।
-- আপনি করে বলছো যে?
-- আমি অপরিচিত মানুষ কে আপনি করেই বলি। সমস্যা?
-- নাহ, সমস্যা নেই।
-- জরুরী কথাটা বলে ফেলেন। ভালো হয়।
-- জানিনা তুমি কথাটা কিভাবে নিবা, তবে খুব
প্রব্লেমে পড়ে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে বাধ্য
হয়েছি।
-- যেভাবে নেয়ার মতো সেভাবেই নিবো৷ না পেচিয়ে
বলে ফেলেন।
-- আমাকে একটা হেল্প করতে পারবা?
-- কি হেল্প?
-- আসলে আমার কিছু টাকা দরকার। খুব জরু….
-- হা হা হা হা, ইউজ করা শেষ হয়নাই এখনও? আরও ইউজ
করতে চাচ্ছেন আমাকে? তিন বছর আগে তো কম করেন
নাই। এখন আবার এসব করে নিজেকে রাস্তার মেয়ে
হিসেবে প্রমান করছেন কেনো? প্লিজ, আপনার প্রতি
আমার যে শ্রদ্ধাবোধটুকু অবশিষ্ট আছে সেটাও শেষ করে
দিয়েন না!
-- স্যরি।
রাইসা ফোন কেটে দিছে। আমি এপাশ থেকে বুঝতে
পারলাম ও কান্না করছে। এভাবে কথা বলা আমার উচিৎ
হয়নি একদম। রাস্তার মেয়ে বলাটা আরও বেশি
বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। ওর প্রতি এতোদিন একটু একটু করে
যে রাগ জমেছে সেটা দমিয়ে রাখতে চাইলেও পারিনি
আমি।
আজ থেকে তিন বছর দুই মাস আগে আমাদের তিন বছরের
সম্পর্ক মুহুর্তেই শেষ হয়ে যায়। তখন আমি সদ্য অনার্স
কমপ্লিট করে বেকার জীবনযাপন করছি।
রাইসার প্রভাব আমার জীবনে বেকারত্বের কষ্টটা বুঝতে
দেয়নি। সারাদিনের কষ্টটা রাতে ওর সাথে কথা বললে
নিমিষেই চলে যেতো। আমার সবকিছু, সকল চিন্তা ভাবনা
তখন রাইসাকে ঘিরেই ছিলো।
খুব ভালোবাসতাম ওকে। হয়তো রাইসাও আমাকে
ভালোবাসতো। কতোটুক ঠিক জানিনা সেটা। কারন
বেকারত্বের কথা টেনে রিলেশনে ইতি টানা মেয়ের
ভালোবাসার গভীরতা কতোটুকু সেটা আমার জানা নেই।
রাইসা চলে যাওয়ার বছর খানেক পর আমি একটা
প্রডাকশন হাউজে জয়েন করি। আমার এতো ভালো
চাকরিটা তখন থাকলে হয়তো আজ আমার জীবনে
ভালোবাসা থাকতো। কিন্তু কিছুকিছু ভালোবাসা
খারাপ সময়ে পড়লে ভালো সময় আসার অপেক্ষা করেনা।
আমার টাও হয়তো সেরকমই ছিলো।
এখন আমি এই প্রডাকশন হাউজের এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর
হিসেবে আছি। বিলাসবহুল জীবন যাপনের সব কিছুই এখন
আমার হাতের নাগালে।
শুনেছি আমার সাথে ব্রেকাপের পর অন্য একটা ছেলের
সাথে রাইসার রিলেশন হয়েছিলো। ছেলেটার বাবা
অনেক ধনী। রাইসাকে দামী দামী গিফট দিতে পারে,
বড়বড় রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে ভালোমন্দ খাওয়াতে
পারে। কিন্তু আমার সাথে থেকে রাইসা এসবের কিছুই
পায়নি। পেয়েছে, একগুচ্ছ হতাশা আর অনিশ্চয়তা। সব
মেয়েরই কিছু স্বপ্ন থাকে, আমি রাইসার কোন স্বপ্ন পূরন
করতে সক্ষম ছিলাম না তখন।
মাঝেমাঝে ভাবতাম হয়তো রাইসা ঠিক সিদ্ধান্তই
নিয়েছে। শুধুশুধু আমার সাথে থেকে নিজের লাইফটা নষ্ট
করবে কেনো?
ব্রেকাপের পর ১ বছর লেগে গেছে নিজেকে স্বাভাবিক
করে তুলতে। এখন আমার লাইফের একটাই টার্গেট। শুধু
টাকা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস টাকা থাকলে অন্য সবকিছু
সহজেই পাওয়া যায়। এমনকি বালিকার ভালোবাসাও তখন
কিনে নেয়া যায় সহজেই। আমি আমার টার্গেট পূরনের
দ্বারপ্রান্তে প্রায়।
আজ যখন রাইসা আমাকে এই টাকার জন্য ফোন দিয়েছে
কেনোজানি সেই আগের ক্ষোভ আমি কন্ট্রোল করতে
পারিনি।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে
ভাবছিলাম। ভাবছিলাম বলতে নিজে থেকেই
ভাবনাগুলো আসছিলো।
রাইসা কি খুব বেশি প্রবলেমে আছে? ওর কিছু হইলে
আমি খুব কষ্ট পাবো। আমি এখনও ওকে ভালোবাসি
আগের মতোই। আমার থেকে দূরে থাকলেও আমি চাই ও
ভালো থাকুক। আমার প্রথম ভালোবাসা এবং একমাত্র
ভালোবাসার মানুষ রাইসা৷ হয়তো সেজন্যই ওর প্রতি
তীব্র রাগ, অভিমান জমলেও ওর প্রতি ঘৃনা টা আমার মন
তৈরী করতে পারেনি। ওর জন্য কেনো জানি টেনশন
হচ্ছিলো খুব।
কোন কিছু না ভেবে নিজের অজান্তেই ফোন দিলাম
ওকে। বেশ কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে রাইসার
কন্ঠ ভেসে আসলো,
-- হ্যালো!
-- ঘুমাচ্ছিলা?
-- হুমম।
-- তোমার ঘুমভাঙা কন্ঠ এখনও আগের মতোই আছে।
-- ওহ।
-- স্যরি, তখন মাথা ঠিক ছিলোনা। তাই অনেক
উল্টাপাল্টা বলে ফেলছি।
-- সমস্যা নেই। আমি কিছু মনে করিনি।
-- তোমার হেল্প লাগবে বলছিলা! কতো টাকা লাগবে?
-- লাগবেনা। আমি ম্যানেজ করতে পারবো।
-- স্যরি বলছি তো।
-- আসলে নাহিদ আমাকে ব্লাকমেইল করতেছে। টাকা
চাচ্ছে অনেক। আমার কাছে এতো টাকা নেই, আর
তাছাড়া গতবছর বাবা মারা গেছে। বাবা মারা যাওয়ার
পর জব খুজছি অনেক, কিন্তু এখনও হয়নি। তাই এতো টাকা
কোথাথেকে পাবো বুঝতে না পেরে তোমার কাছে ফোন
দিয়েছিলাম।
-- নাহিদ কে?
-- আমার বয়ফ্রেন্ড। ও আমার কিছু ভিডিও রেকর্ড করে
এখন ব্লাকমেইল করতেছে। বুঝতেছিনা কি করবো আমি!
-- স্যরি, বুঝতে না পেরে তোমার সাথে তখন খারাপ ভাবে
কথা বলছি অনেক। কতো টাকা চাচ্ছে?
-- দুই লাখ টাকা।
-- টেনশন করোনা৷ আমি কালকে টাকা পাঠিয়ে দিবো।
আর তুমি চাইলে আমার অফিসে জয়েন করতে পারো।
আমি জবের ব্যাবস্থা করে দিবো।
-- টাকা লাগবেনা আমার। কিছুই লাগবেনা।
-- তুমি এখনও রেগে আছো।
-- না না, আমি রেগে নেই। আসলে তোমার সাথে আমিই
নিজের স্বার্থের জন্য ব্রেকাপ করেছি৷ অনেক কষ্ট
দিছি তোমারে। তারপরেও তোমার কাছে হেল্প
চাওয়াটা আমার ঠিক হয়নি। পারলে মাফ করে দিও।
-- এভাবে কেনো কথা বলছো?
-- ঘুম পাচ্ছে খুব। ঘুমাবো।
-- আচ্ছা, শুভরাত্রি।
,
ফোন রেখে দেয়ার পর তীব্র এক খারাপ লাগা আমাকে
চেপে ধরে। রাইসার সাথে ওরকম বিহেভ করা একদমই ঠিক
হয়নি আমার। অনেক্ষন ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছি, ঘুম
আসছেনা।
মাথায় পুরোনো নতুন চিন্তারা এসে ভীড় জমাচ্ছে।
সেইসব চিন্তা আর ঘুমঘুম ভাব মিলে অন্যরকম একটা
অনুভূতি সৃষ্টি করছে। মাতাল মতাল লাগছে খুব।
জানালার ধারে গিয়ে সিগারেট জ্বালালাম একটা।
গভীর রাত, বাইরে মাঝেমাঝে দু একজন নিশাচর হেটে
চলে যাচ্ছে।
সকাল বেলা কলিং বেলের শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। দরজা
খুলে দেখলাম গোটা কয়েক পুলিশ আমার দরজার সামনে
দাড়িয়ে।
আমি তাদের সামনে যেতেই একজন বললো,
-- আপনি মিস্টার সাজ্জাদ?
-- হ্যা। কি হয়েছে?
-- আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।
-- কি হইছে, বুঝিয়ে বলবেন প্লিজ?
-- গতকাল রাতে রাইসা নামের এক মেয়ে মারা গেছে।
প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে আপনার নাম আসছে। তাই
আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় যেতে হবে।
,
আমাকে থানায় নেয়ার বেশ কয়েক ঘন্টা পর রাইশার
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসে। রিপোর্ট হাতে পেয়ে
থানার ওসি আমার দিকে কয়েকবার আড়চোখে তাকায়।
মাঝেমাঝে তার চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছিলো,
সঙ্গেসঙ্গে আমি চোখ সরিয়ে নেই। একটুপর আমার দিকে
এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
-- রাইশার সাথে আপনার কি সম্পর্ক।
-- সম্পর্ক নেই। তিন বছর আগে সম্পর্ক ছিলো।
-- গতকাল রাতে আপনাকে ফোন দিয়েছিলো কেনো?
-- এমনিই খোজখবর নেয়ার জন্য হয়তো। ঠিক জানিনা।
পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে কি আসছে বলবেন প্লিজ?
-- সুইসাইড।
আমি কিছুক্ষন এক দৃষ্টিতে পাশের দেয়ালের দিকে
তাকিয়ে রইলাম। আমি গতকাল রাইশাকে মেন্টালি
টর্চার করেছি। অনেক বাজে ভাবে কথা বলেছি।
শারিরিক টর্চারের থেকে মেন্টাল টর্চার সহ্য করার
ক্ষমতা মানুষের কম থাকে। সে হিসেবে রাইশার মৃত্যুর
জন্য আমিই দায়ী। হয়তো আইনের কাছ থেকে বেচে
যাবো। কিন্তু বিবেকের কাছে প্রতিনিয়ত বিচারের
মুখোমুখি হতে হবে আমায়।
ওসি সাহেব তার টেবিলে ফিরে যেতে যেতে বললেন,
-- আপনি এখন যেতে পারেন। প্রয়োজন হলে পরে আবার
ডাকবো।
এর আগে কখনও থানায় আসতে হয়নি আমার। প্রথমবার
এসেছি আজকে, তাও সন্দেহভাজন খুনি হিসেবে। আমার
ভালোবাসার খুনি হিসেবে।
ওভার ব্রিজের উপর দাড়িয়ে আছি। মাথার ভেতর
বিচ্ছিন্ন কিছু ভাবনা এসে তালগোল পাকাচ্ছিলো।
আমি এসব নিয়ে আর ভাবতে পারছিনা। সবকিছু ভুলে
যেতে চাচ্ছি, স্মৃতি থেকে কালকের দিনটাকে মুছে
ফেলতে চাচ্ছি। সব কিছু আগের মতো হয়ে যাক।
আমার সাইড ঘেষে "চা-এএএ গরম" বলতে বলতে এক লোক
চলে যাচ্ছিলো৷ আমি তাকে থামিয়ে এককাপ চা আর
সাথে একটা সিগারেট নিয়ে আবারও দূরে তাকিয়ে
রইলাম।
অনেকের কাছেই শুনেছি, "প্রথম ভালোবাসা কখনও
ভোলা যায়না। সময়ের সাথে মানিয়ে নিতে হয়।"
আমিও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। ঝুম বৃষ্টি,
শীতকাল, আর কিছুকিছু মুভি মাঝেমধ্যে রাইশার কথা
মনে করিয়ে দিতো। কিন্তু পরক্ষনেই ভুলে যেতাম। কষ্ট
হতোনা একটুও।
কিন্তু আজ কেনো জানি রাইশার কথা জোর করেও ভুলতে
পারছিনা। কষ্ট হচ্ছে খুব।
মানুষ মরে গেলে তাকে সবাই ভুলে যায়। কথাটা
পুরোপুরি ঠিকনা। সবাই তাকে ভুলে যায়না। কিছুকিছু
মানুষ তাকে মনে রাখে। বাস্তব থেকে অবাস্তব হয়ে
যাওয়া মানুষটাকে তাদের মন আরও বেশি পরিমানে
স্মরন করতে থাকে। সেই কিছুকিছু মানুষ গুলাই হয়
ভালোবাসার মানুষ।
রাইশা বেচে থাকলে হয়তো ওকে ভুলে থাকা আমার জন্য
খুব সহজ হতো। কিন্তু এখন ওর স্মৃতি আমাকে সারাজীবন
বয়ে বেড়াতে হবে।
,
সন্ধার দিকে রাইশার এক আত্মীয় এসে আমাকে একটা
ডায়েরি দিয়ে যায়। বললো,
--" রাইশা একটা কাগজে এই ডায়েরিটা আপনাকে দেয়ার
কথা লিখে গেছিলো। এটা আপনি রাখেন।"
কভার পেজে নীল কালী দিয়ে গোটাগোটা অক্ষরে
লেখা "রাইশা"।
আমি বুঝতে পারছিলাম, ডায়েরিটা আমার পড়া ঠিক
হবেনা৷ কারন এটা আমার কষ্ট বহুগুনে বাড়িয়ে দিবে।
জানিনা এতে কি লিখা আছে, তবুও মনেহচ্ছে পড়া ঠিক
হবেনা।
তবুও আমি পড়া শুরু করলাম।
ছয় বছর দুইমাস আগেকার তারিখ।
সেদিন আমি ওকে ফার্স্ট প্রপোজ করি।
ডায়েরির প্রথম পাতায় একটু বড় করে আড়া আড়ি ভাবে
লেখা,
--" প্রতিটা মেয়েরই স্বপ্ন থাকে কেউ একজন তাকে খুব
ভালোবাসুক, তার জন্য হাজারো পাগলামি করুক। কেউ
একজন তাকে স্বপ্ন দেখাতে শেখাক। আজ নতুন মানুষের
সাথে নতুন করে স্বপ্নদেখা শুরু। স্বপ্ন ছিলো কেউ একজন
যাকে আমিও পছন্দ করি আমার সামনে এসে হাটু গেড়ে
সিনেম্যাটিক স্টাইলে বলুক ' I Love You'। সেই স্বপ্ন
পূরনের দিন আজ।
লেখাটার দুপাশে বড় করে দুটো হার্ট সাইন আকা। বুঝতে
পারলাম ডায়েরিটা আমাদের রিলেশন শুরু হওয়ার দিন
থেকেই লেখা হয়েছে।
আমাদের ৩ বছরের রিলেশনের প্রত্যেকটা ঘটনা
ডায়েরির পাতায় জ্বলজ্বল করছিলো। মাঝেমধ্যে
কিছুকিছু লেখা পড়ে হাসিও পাচ্ছিলো খুব। অজান্তেই
কাদতে কাদতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলাম। এক
জায়গায় লিখেছে,
-- আজ তুমি আমাকে অনেক বকা দিছো। একসময় আমি
ঠিক এর প্রতিশোধ নিবো। বাসায় ঢুকতে দিবোনা, বাইরে
দাড় করিয়ে রাখবো।
ভার্সিটিতে থাকাকালীন একবার ক্লাস শেষে প্রচুর
বৃষ্টি শুরু হলো। সবাই বাসায় যাওয়া নিয়ে টেনশন
করছিলো, এদিকে সন্ধাও হয়ে আসতেছিলো।
আমি রাইশার হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে বের হয়ে আসি।
মুহুর্তেই দুজনে ভিজেটিজে একাকার হয়ে গেছি। গেটে
এসে রিক্সা নিলাম। রাইসা রিক্সার হুড ওঠাতে চাইলো,
আমি দিলাম না। সারারাস্তা ভিজতে ভিজতে আসলাম
দুজন।
ওর বাসার কাছে এসে ওকে নামিয়ে দিতে দিতে বললাম,
-- ভিজলে তোমাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগে।
রাইশা ভেঙচি কেটে ভেতরে চলে যায়।
সেই ঘটনাটাও ডায়েরিতে লিখে রাখছে,
--"আজ তুমি আমাকে বৃষ্টিতে ভিজাইছো। সর্দি লেগে
অবস্থা খারাপ আমার। এর জন্য কে দায়ী? তুমি। এভাবে
রোমান্স করার জন্য গার্লফ্রেন্ডকে কেউ অসুস্থ বানায়?
কেমন বয়ফ্রেন্ড তুমি?
ডায়েরির একটা পাতায় ব্রেকাপের প্রায় বছর দুয়েক
পরের একটা তারিখ দিয়ে লেখা,
-- অনেক কিছুই হারিয়েছি জীবন থেকে। কিন্তু তার
কোনটার জন্যই আফসোস হয়নি আমার। কিন্তু দুটো
হারানো জিনিসের জন্য আমার সারাজীবন আফসোস
থাকবে প্রথম আমার ভালোবাসা 'সাজ্জাদ' যে আমাকে
পাগলের মতো ভালোবাসতো। দ্বিতীয়, আমার বাবা। যে
আমাকে জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসতো।
মাঝেমাঝে ইচ্ছা হয় যদি এদেরকে আবার আমার জীবনে
ফিরে পেতাম! আর কখনও হারাতে দিতাম না।
আর পড়তে পারছিনা আমি। এসব সহ্য করার ক্ষমতা নেই
আমার। ডায়েরিটা বন্ধ করতে গিয়ে শেষ পাতায় চোখ
পড়লো।
চারটা শুকনো বেলীফুল রাখা। রাইশা যেদিন সুইসাইড
করে সেদিনের তারিখ।
-- মনে আছে তোমার! একদিন এই চারটা বেলীফুল দিয়ে
তুমি আমাকে প্রপোজ করেছিলা? বলছিলা, "
ভালোবাসায় চারটা অক্ষর আছে তাই চারটা বেলীফুল
দিয়ে তোমাকে আমি ভালোবাসা দিলাম, রাখবা?"
দেখছো! তোমার ভালোবাসা আমি এখনও রেখে দিছি।
আমি জানি তোমাকে আমি অনেক কষ্ট দিছি। পারলে
মাফ করে দিও।
সুযোগ হলে একদিন আমার কবরের পাশে গিয়ে বেলীফুল
গুলো রেখে আইসো!
,
পাশের বিল্ডিং এর জানালা দিয়ে এক পিচ্চি মেয়ে
উচ্চগলায় বললো,
-- ভাইয়া! আপনি কাদতেছেন কেনো? আম্মু দেখো, অই
বাসার এক ভাইয়া কাদতেছে।
আমি পিচ্চিটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়ার
চেষ্টা করে জানালার পর্দা টেনে দিলাম।
নিজের কান্নার আওয়াজ নিজের কানে এসে
বাজেভাবে লাগছে। প্রথম ভালোবাসা আসলেই বড়
অদ্ভুত।
****
বছর পাচেক পর।
রাতে সাবিহার থেকে লুকিয়ে বেলকোনিতে দাড়িয়ে
সিগারেট ফুকছি। সাবিহা আমার ওয়াইফ। বছরখানেক
আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে ওর সাথে।
সাবিহা একটা ধুলোপড়া ডায়েরি এনে আমার হাতে
দিয়ে বললো,
-- রাইশা কে?
এমনিতে হুট করে এভাবে সামনে চলে আসলে আমি
তাড়াতাড়ি করে সিগারেট হাত থেকে ফেলে পা দিয়ে
পিষে দেই। সাবিহা তাতেই খুশি হয়। আজকে নিজের
অজান্তেই সিগারেটটা হাতে ধরে রাখলাম।
-- হ্যালো! শুনছো? জিজ্ঞেস করছি, রাইশা কে? এই
ডায়েরির উপর রাইশা নাম লেখা কেনো?
-- দেখবা রাইশা কে?
-- হুমম।
সাদা রঙের দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটা কবরের পাশে এসে
দাড়ালাম আমি আর সাবিহা। সাদা দেয়ালটায় শ্যাওলা
জমে সবুজ একটা ভাব চলে এসেছে। আশেপাশে কিছু
জংলা গাছ জন্মেছে। আঙুল দিয়ে এপিটাফের দিকে
দেখিয়ে বললাম,
-- এই যে রাইশা। আমার ভালোবাসা। প্রাক্তন
ভালোবাসা।
লেখকঃঃ সিফু 

No comments

Powered by Blogger.