Header Ads

অন্তহীন মেঘ

ক্যাম্পাসের যে মেয়েটা আমার পছন্দ, সে আমাকে চেনে না। আমি তাকে প্রায়ই ফলো করি। তাকে দেখি আড়চোখে। আমি মনে হয় মোহে আছি। এটা হয়তো প্রেম ভালবাসা কিছুই না। ভালবাসা জিনিসটা কি আমার জানা নাই। কিন্তু আজ তাকে চিরকুট দিব। ভালবাসার চিরকুট। আমি আবার খুব সাহসী বালক নই। নিজে গিয়ে চিরকুট টা তুলে দিতে পারব না। অত সাহস আমার নাই। 
.
মোবাইলটা হাতে নিয়ে তানিশা কে নক দিলাম। 
- তুই কি চলে এসছিস? 
- তোর কতক্ষণ লাগে? দশ ঘণ্টা ধরে বসে আছি। তুই আয় শুধু। কান ছিঁড়ে ফেলব। 
- রাগ করিও না বান্ধবী। আসছি দুই মিনিট। 
.
তানিশা। আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী। কাছের মানুষ। এই দুই বছরের পরিচয়ে মেয়েটা অনেক আপন হয়ে গেছে। মেয়েটা কেন আমাকে এত কেয়ার করে বুঝি না। ভার্সিটির সেরা বন্ধু তানিশা। মনের যত কথা সব ওর সাথে শেয়ার করি। ঐতো ক্যাফেটেরিয়ায় গাল ফুলিয়ে বসে আছে তানিশা। আমি কাছে গিয়ে তিনবার কান ধরে উঠবস করলাম। তানিশা বলল, 
- হইসে অফ যা। তুই কখনোই ঠিক হবি না। 
.
আমি ওর মুখোমুখি বসে আছি। চিরকুটটা এগিয়ে দিলাম। সে বলল, এটা কি? 
আমি তাকে মেসেজে লিখে দিলাম, 
- চিরকুটটা রানুর জন্য। ওকে দিস। 
- এহ তোর মত বোবা ছেলেকে কেউ বিয়ে করবে ভাবিস? 
আবার লিখলাম, অবশ্যই করবে। কেউ না করলে তুই তো আছিস। 
- খেয়েদেয়ে কাজ নাইতো তোকে বিয়ে করব! বোবা কোথাকার!
- থাক বিয়ে বাদ। আপাতত এই কাজটা করে দে। 
- ওকে আমি হলে গিয়ে দিয়ে আসব। আকাশে কি মেঘ দেখছিস? 
.
আকাশে বিশাল মেঘ। যেকোন সময় বৃষ্টি নামবে। আমি আকাশ দেখি। চোখ বন্ধ করে দেখছি। মুখে কথা বলতে না পারলেও মনে মনে কথা বলতে পারি। মেঘটা গর্জন দিয়ে বৃষ্টি নেমে এলো। তুমুল বৃষ্টি। আমি বাড়িতে পৌঁছলাম ভিজতে ভিজতে। ফ্রেশ হয়ে তানিশাকে নক দিলাম, 
- চিঠিটা দিয়েছিস? 
ও এখন অফলাইনে। অনলাইনে আসলে রিপ্লাই দিবে। 
.
রাত নয়টা। মা খেতে ডাকছে। তানিশা এখনো অনলাইনে আসছে না। যে মেয়েটা সারাদিন আমার সাথে চ্যাট করে তার আজ খবর নাই। কল দিলাম। সুইচ অফ। 
- তনয় খেতে আয়। 
আমি মায়ের সাথে খাচ্ছি। রান্নাটা খুব ভাল হয়েছে। কিন্তু বলতে পারছি না মা, রান্নাটা খুব চমত্‍কার হয়েছে। নিজেকে অপরাধী লাগে। আমার এই অবস্থা বাবা মেনে নিতে পারেনি। সবসময় মা বাবার ঝগড়া লেগে থাকত আমাকে নিয়ে। আমি যে বাবা ডাকতে পারব না এইটা হয়তো বাবা কখনো মেনে নিতে পারেনি। বাবা আমাদের ফেলে চলে যান যখন আমার বয়স ৫। মা আমাকে একাই বড় করেছেন। নিজেই চাকরি করে সংসার চালান। আমার ধারণা মা হয়তো বেশিদিন বাঁচবে না। ঠান্ডা লাগিয়ে লাগিয়ে ফুসফুসের হয়তো বারটা বেজে গেছে। নিজেও ডাক্তার দেখান না, আমাকেও কিছু বলেন না। কিন্তু আমি বুঝি। তবে মা বাবার মাঝে ভালবাসার সম্পর্কটা পাহাড় সমান। বাবা এখনো আরেকটা বিয়ে করেননি। 
.
ক্যাম্পাসে পরেরদিন তানিশার সাথে দেখা। কোন কারণে তার মন খারাপ মনে হচ্ছে। আমার পাশে চুপচাপ বসে আছে। আমরা মেসেজে বেশিরভাগ সময় মেসেজে কথা আদানপ্রদান করি। 
- কিরে কাল রিপ্লাই দিলি না কেন?
- ভাল লাগছিল না। 
- কেন? 
- রানু তোর প্রপোজাল এক্সেপ্ট করেনি। 
- ব্যাপার না। এইজন্য তোর মন খারাপ করা লাগে নাকি? পাগল ছাগল! 
- হুম। 
- চল ফুচকা খাই। 
- নাহ। 
- আমি যাচ্ছি। না আসলে মিস। 
.
ক্লাস থেকে বের হয়ে ফুচকার দোকানে গেলাম। আমি জানি তানিশা আসবে। কিছুক্ষণ পর ঠিকই আসলো। তার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিলাম। 
.
নয় মাস পরের কথা। এখন এপ্রিল মাস। শীতকালটা খুব বাজে গেল। আম্মার জন্য। শেষমেষ হাসপাতালে ভর্তি হতেই হল মাকে। ডাক্তার বলেই দিয়েছে কন্ডিশন খুব খারাপ। খুব বেশিদিন হয়তো বাঁচবে না। আমি মায়ের পাশে বসে আছি। মা গল্পের বই পড়ছেন। আমার লিখা গল্পের বই। দুমাস আগে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পের বইটা খুব সাধারণ। বাবাকে নিয়ে লেখা। নিজের বাবা না। কাল্পনিক বাবা। মা হয়তো রাগ করবেন কেন মাকে নিয়ে লিখলাম না। খুব বলতে ইচ্ছা করছে সামনে বছর লিখব। ততদিন কি বেঁচে থাকবে মা?
.
হাসাপাতালে একটা মেয়ে আসছে। রানু। রানু এখানে কেন? খুব অবাক হচ্ছি। আমাকে ডেকে বলল, 
- তনয় একটা জরুরি কথা বলতে এসছি। তুমি হয়তো জানো না আমি তানিশার রুমমেট। তানিশা তোমাকে অনেক ভালবাসে। তুমি কখনো বুঝো নি। সেদিন তোমার চিঠিটা আমাকে দিয়ে বলল, তনয় তোকে পছন্দ করে। তারপর চলে গেল। খুব বৃষ্টি ছিল। সে দুইঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজে শুধু কেঁদেছে। তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। 
.
রানুর কথা শুনে আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেল। কেন আমি এত বোকা? মেসেজ দিয়ে তানিশার সাথে দেখা করলাম। 
.
- কেন একবার বললি না ভালবাসিস? 
- সব মুখে বলতে নেই। 
- একবার বলতি। বিয়ে কবে? 
- পরশু শুক্রবার। 
- এই বোবা ছেলেটাকে ফেলে চলে যাবি? 
মেসেজে লিখছি আর তানিশাকে দেখছি আড়চোখে। সে কোন রিপ্লাই দিচ্ছে না। মোবাইলটা পকেটে রেখে দিলাম। তানিশা চুপচাপ আমার কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকলো। 
.
শুক্রবার। মায়ের অবস্থা আরো জটিল। আমি মায়ের হাত ধরে বসে আছি। পিছনে কখন আমার বাবা এসে দাঁড়িয়ে আছেন আমি খেয়াল করিনি। মা ইশারায় বাবাকে দেখালেন। আমি তাকিয়ে দেখি বাবা কাঁদছেন। খুব বলতে ইচ্ছা করছে, "ধন্যবাদ বাবা। মা হয়তো তোমাকে শেষবার দেখার জন্য এত কষ্ট করে বেঁচে আছেন।" বাবা আমাকে জড়িয়ে হাউমাউ
করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, "আমাকে মাফ করে দে বাবা! তোর সামনে দাঁড়ানোর মুখ আমার নাই। তোর যে গল্পের বই বের হয়েছে সেই খবরও আমি রেখেছি। পড়ে শুধুই কেঁদেছি। লজ্জায় তোর সামনে আসতে পারিনি বাবা! মাফ করে দে..." আমি বাবার চোখের পানি মুছে দিলাম। মায়ের পাশে বসালাম। মায়ের চোখের কোণা দিয়ে পানি পড়ছে। বাবার দিকে তাকিয়ে আছেন। বাবা উনার হাতটা শক্ত করে ধরলেন। কিন্তু লাভ হল না। মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
.
বাইরে এসে তানিশাকে মেসেজ দিলাম।
- জানিস আমার বাবা ফিরে এসছেন।
- আমিতো আগেই বলেছিলাম একদিন ফিরবেনই। তুইতো বিশ্বাস করিস না।
- বিয়ে তো করেই ফেললি। বর কেমন?
- খুবই ভাল। তোর মত বোবা না। অনেক কথা বলে।
- হাহা। তুই অনেক ভাল মেয়ে। 
- এতদিন তো পচিয়ে শেষ করে দিতি। যাক অবশেষে প্রশংসা করলি। 
- হ্যাঁ রে। বোকা ছিলাম যে আমি। 
- হুম খুবই বোকা।
- ভাল থাকিস তানিশা।
- হুম। তুইও ভাল থাকিস সবসময়।
.
মোবাইলটা পকেটে রেখে আমি আকাশের দিকে তাকালাম। বাবা হয়তো এখনো মায়ের হাত ধরে বসে আছেন। আর আমি আকাশ দেখছি। কালো মেঘ জমেছে। কালবৈশাখী ঝড় হবে মনে হয়।

No comments

Powered by Blogger.