কাগজের নৌকা
খুব বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে দেখি রাস্তা ডুবে গেছে পানিতে। পাশের বাসার টিনএজ মেয়েটা মন খারাপ করে বসে আছে চেয়ারে। হাতের কাছে কিছু সাদা কাগজ নিয়ে সে আনমনে নৌকা বানিয়ে গ্রিলের দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলছে। নৌকাগুলি বড় অসহায়। পানিতে ভেসে ভেসে যাবার আগেই বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটার আঘাতে ডুবে যাচ্ছে। মেয়েটার তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সে ক্রমশই নৌকা বানিয়ে চলেছে।
.
"আপনি কি বলতে পারবেন জগতের সবই পূর্বনির্ধারিত কিনা?"
.
মেয়েটা আমার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আমি তার প্রশ্নটি নিয়ে ভাবছি না, তার নামটি বরং মনে করবার চেষ্টায় আছি। মেঘা কিংবা বর্ষা---এ জাতীয় নাম হবে তার। আমি বললাম, আপনার মনটা খারাপ কেন জানতে পারি?
.
মেয়েটি চমকালো বলে মনে হল। আমার দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হেসে বলল, মন খারাপ নেই তো।
.
"সত্যটা লুকাবেন না। আমি কিন্তু সত্য-মিথ্যাকে আলাদা করতে পারি।"
.
"তাই?"
.
"জ্বী। সারাজীবন অন্যের বাড়িতে থেকে মানুষ হয়েছি তো। তাই আমাকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হয়েছে আমার সম্পর্কে কে কী ভাবছে। সেই থেকে লক্ষ্য করলাম আমি নিজেও অনেক কিছু বুঝতে পারি।"
.
মেয়েটা তাকিয়ে আছে, কিছু বলছে না। আমি নিজ থেকেই বললাম, আমি বছর দুয়েক আগে গ্রাম থেকে এসেছি। এটা আমার মামার বাড়ি। বর্তমানে আমি চাকরী খুঁজছি। চাকরী পেলেই ভাড়া বাসায় গিয়ে উঠব।
.
"আপনার নামটা জানতে পারি?"
.
"আমি জামিল আহমেদ। আর আপনার নাম মনে হয় মেঘা, তাই না?"
.
"কে বলল? আমার নাম নিধি।"
.
"ও আচ্ছা।"
.
"আপনি ঠিকই ধরেছেন, আজ আমার মন খারাপ। এতদিন আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করতাম না। আজ করতে বাদ্ধ হচ্ছি।"
.
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলি, কী নিয়ে প্রবলেম হয়েছে?
.
"আজ আমার বয়ফ্রেন্ডের বিয়ে। অথচ আমি মনে করতাম তাকে কেউ আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। কিন্তু ভাগ্য সব ছিনিয়ে নিয়েছে।"
.
আমি শব্দ করে হেসে দিলাম। নিধি আহত গলায় বলল, আপনি হাসছেন?
.
"আপনার আর আমার মেন্টালিটির তফাৎ দেখে হাসি পাচ্ছে।"
.
"আপনারও হৃদয়ঘটিত কোনো সমস্যা আছে বুঝি?"
.
"ঠিক তা নয়। একটা মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল, আমি বেকার জেনেও সে আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল। তার পরিবারের মত নিয়েই বিয়ের আয়োজন শুরু হয়। বিচিত্র ব্যাপার, গায়ে হলুদের একদিন আগেই বিয়েটা ভেঙে যায়। ঐ মেয়েটাই বিয়ে ক্যানসেল করে দেয়। আমি কিন্তু তাতে একটুও মনঃক্ষুণ্ণ হইনি।"
.
"নিজেকে দিয়ে সবার বিচার করাটা কি ঠিক?"
.
"বিচার করছি না, সঠিক রাস্তাটা দেখিয়ে দিচ্ছি। আপনি বয়সে আমার জুনিয়র। আপনাকে সঠিক রাস্তা দেখাবার অধিকার আমার আছে।"
.
কথাটি যেন বলা অনুচিত ছিল। নিধিকে দেখলাম রাগী চোখে চেয়ে থাকতে। সে বলল, আমাকে দয়া করে কোনো উপদেশ দেবেন না।
.
এটা বলেই সে দ্রুতপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ভেতরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। আমার অপমানিত হওয়া উচিত। কিন্তু কোনো অপমানই গায়ে মাখলাম না। উদাস মুখে সিগারেট টানতে লাগলাম। বৃষ্টি তখনও হয়ে চলেছে অবিরাম।
.
.
ক'দিন ধরে খুব ব্যস্ত আমি। চাকরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য ছুটাছুটি করে চলেছি। তারওপর রাত জেগে চাকরীর জন্য পড়াশুনা করা। খুবই ধকল যাচ্ছিল। তবু গাছের মত সহিষ্ণু আর নদীর মত সমর্পণতা নিয়ে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় মনে বেধে রেখেছিলাম। একদিন সকালে বাজার করে ফেরার পথে অনুভব করি শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে। সেইসাথে মাথাটাও ঘুরছে। এসময় বাড়ির কাছে আসতেই নিধির সাথে দেখা।
.
"ভাইয়া, একটা হেল্প করবেন প্লীজ?"
.
"কী হেল্প?"
.
"একটা ছেলে তখন থেকে ফোনে পাগলের মত প্রলাপ বকছে। তাকে একটু ধমক দিন।"
.
"কে সে?"
.
"চিনি না। আননোন নাম্বার।"
.
"ঠিক আছে, ফোনটা দাও আমাকে।"
.
রিসিভার কানে তুলে নিয়ে কয়েকবার ধমকের সুরে কথা বলতেই একটা মেয়ে ওপাশ থেকে নরম সুরে বলল, সরি, কিছু মনে করবেন না। এটা আমার কাজিন ছিল। ও আসলে মানসিক প্রতিবন্ধী। দয়া করে তাকে মাফ করবেন।
.
কন্ঠস্বরটা ভীষণ চেনা লাগছিল। তাই জিজ্ঞেস করি, আপনার নামটা জানতে পারি?
.
"জ্বী, আমি মীরা।"
.
মীরা! বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পিটিয়ে চলেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে বলি, মিরপুরে থাকেন বুঝি?
.
"হ্যা।"
.
আমি আর বিস্ময় এবং আবেগ সামলে রাখতে পারি না। নরম সুরে বলি, কেমন আছো মীরা?
.
ওপাশটা নীরব।
.
আবার বলি, মীরা, ভাল আছো তো?
.
সাথে সাথে লাইন কেটে দেয় মীরা। আমি হতাশ চোখে ফোনের স্ক্রীনের দিকে চেয়ে থাকি। নিধি বলে, মীরা কে?
.
"তোমাকে বলেছিলাম না একটা মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হবার পরও ক্যানসেল হয়ে গিয়েছিল, মীরা হল সেই মেয়ে।"
.
নিধি কিছুক্ষণের জন্য মৌনতায় ডুবে থেকে কন্ঠস্বরে দ্বিধাদ্বন্দ্ব মিশিয়ে বলে, দেখুন, আমার সামনে কোনো ইরা-মীরার নাম উচ্চারণ করবেন না।
.
"মানে?"
.
নিধি উত্তর না দিয়ে ছুটে চলে যায় ঘরের ভেতর। আর আমি অবাক চোখে ওর চলে যাওয়া দেখি।
.
বাড়ি ফিরে কঠিন জ্বরের অস্তিত্ব টের পাই আমি। প্রচন্ড শীতানুভূতি নিয়ে কম্বল গায়ে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। তারপর জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করতেই ঘুম। একসময় চোখ মেলে দেখি মুখের ওপর মামা-মামীর ভ্রু কুঞ্চিত মুখ ভেসে আছে। আবিষ্কার করি আমার মুখের ভেতর থার্মোমিটার গুজে রাখা। মামা থার্মোমিটার বের করে বলেন, জ্বর তো ১০৪ ডিগ্রী!
.
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই অস্পষ্টভাবে অনুভব করি কেউ একজন মাথার কাছে বসে আছে। কে? মীরা? আমি ডাকি, মীরা! কেউ এলজন ইতস্তত করে বলে, ভাইয়া, আমি নিধি।
.
"ও আচ্ছা।"
.
নিধি অনেক কথায় বলতে থাকে। সেই কথাগুলোর সিংহভাগই জ্বরের ঘোর কৃষ্ণগহ্বরের মত শুষে নেয়। একসময় অনুভব করি নিধি পরম মমতায় আমার হাতটি ধরেছে। সে কপালেও হাত রাখলো। পারদের মতো গাঢ় আবেগ প্রসারিত হল তখন।
.
সেদিন রাতে নিধিকে স্বপ্নে দেখলাম। খুবই সাধারণ স্বপ্ন, তবু আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম তাতে। দেখলাম, প্রচন্ড বৃষ্টিতে দুজনে একসাথে বারান্দায় বসে কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ফেলছি। ব্যস, এটুকুই। কিন্তু স্বপ্নটার রোমাঞ্চকর অনুভূতিটা ছিল অবর্ণনীয়।
.
চারদিনের মাথায় জ্বর সারলো আমার। শুরুতেই তখন নিধিকে দেখতে মন চাইলো। আমি বারান্দায় চলে এলাম। কিন্তু নিধিদের বারান্দা সম্পূর্ণ খালি পড়ে থাকতে দেখলাম, একটা আসবাবও সেখানে নেই। পরে যা জানতে পারি তার জন্য আমার প্রস্তুতি ছিল না। নিধির বাবা বদলী হয়ে পুরো পরিবার নিয়ে সিলেট চলে গেছেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল ভীষণ। নিধিকে নিয়ে যে অব্যক্ত অনুভূতি মনের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে ছিল সবই ফিকে হতে শুরু করলো।
.
আজকের আকাশটা শুরু থেকেই মেঘাচ্ছন্ন ছিল। হঠাৎ-ই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামলো। আমি শূন্য দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছি। আর অপেক্ষা করছি কখন পাশের বারান্দায় নিধি আসবে? কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ছাড়বে? যদিও জানি আমার এই অপেক্ষার সুষ্ঠু প্রতিফলন ঘটবে না।
.
"আপনি কি বলতে পারবেন জগতের সবই পূর্বনির্ধারিত কিনা?"
.
মেয়েটা আমার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আমি তার প্রশ্নটি নিয়ে ভাবছি না, তার নামটি বরং মনে করবার চেষ্টায় আছি। মেঘা কিংবা বর্ষা---এ জাতীয় নাম হবে তার। আমি বললাম, আপনার মনটা খারাপ কেন জানতে পারি?
.
মেয়েটি চমকালো বলে মনে হল। আমার দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হেসে বলল, মন খারাপ নেই তো।
.
"সত্যটা লুকাবেন না। আমি কিন্তু সত্য-মিথ্যাকে আলাদা করতে পারি।"
.
"তাই?"
.
"জ্বী। সারাজীবন অন্যের বাড়িতে থেকে মানুষ হয়েছি তো। তাই আমাকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হয়েছে আমার সম্পর্কে কে কী ভাবছে। সেই থেকে লক্ষ্য করলাম আমি নিজেও অনেক কিছু বুঝতে পারি।"
.
মেয়েটা তাকিয়ে আছে, কিছু বলছে না। আমি নিজ থেকেই বললাম, আমি বছর দুয়েক আগে গ্রাম থেকে এসেছি। এটা আমার মামার বাড়ি। বর্তমানে আমি চাকরী খুঁজছি। চাকরী পেলেই ভাড়া বাসায় গিয়ে উঠব।
.
"আপনার নামটা জানতে পারি?"
.
"আমি জামিল আহমেদ। আর আপনার নাম মনে হয় মেঘা, তাই না?"
.
"কে বলল? আমার নাম নিধি।"
.
"ও আচ্ছা।"
.
"আপনি ঠিকই ধরেছেন, আজ আমার মন খারাপ। এতদিন আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করতাম না। আজ করতে বাদ্ধ হচ্ছি।"
.
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলি, কী নিয়ে প্রবলেম হয়েছে?
.
"আজ আমার বয়ফ্রেন্ডের বিয়ে। অথচ আমি মনে করতাম তাকে কেউ আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। কিন্তু ভাগ্য সব ছিনিয়ে নিয়েছে।"
.
আমি শব্দ করে হেসে দিলাম। নিধি আহত গলায় বলল, আপনি হাসছেন?
.
"আপনার আর আমার মেন্টালিটির তফাৎ দেখে হাসি পাচ্ছে।"
.
"আপনারও হৃদয়ঘটিত কোনো সমস্যা আছে বুঝি?"
.
"ঠিক তা নয়। একটা মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল, আমি বেকার জেনেও সে আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল। তার পরিবারের মত নিয়েই বিয়ের আয়োজন শুরু হয়। বিচিত্র ব্যাপার, গায়ে হলুদের একদিন আগেই বিয়েটা ভেঙে যায়। ঐ মেয়েটাই বিয়ে ক্যানসেল করে দেয়। আমি কিন্তু তাতে একটুও মনঃক্ষুণ্ণ হইনি।"
.
"নিজেকে দিয়ে সবার বিচার করাটা কি ঠিক?"
.
"বিচার করছি না, সঠিক রাস্তাটা দেখিয়ে দিচ্ছি। আপনি বয়সে আমার জুনিয়র। আপনাকে সঠিক রাস্তা দেখাবার অধিকার আমার আছে।"
.
কথাটি যেন বলা অনুচিত ছিল। নিধিকে দেখলাম রাগী চোখে চেয়ে থাকতে। সে বলল, আমাকে দয়া করে কোনো উপদেশ দেবেন না।
.
এটা বলেই সে দ্রুতপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ভেতরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। আমার অপমানিত হওয়া উচিত। কিন্তু কোনো অপমানই গায়ে মাখলাম না। উদাস মুখে সিগারেট টানতে লাগলাম। বৃষ্টি তখনও হয়ে চলেছে অবিরাম।
.
.
ক'দিন ধরে খুব ব্যস্ত আমি। চাকরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য ছুটাছুটি করে চলেছি। তারওপর রাত জেগে চাকরীর জন্য পড়াশুনা করা। খুবই ধকল যাচ্ছিল। তবু গাছের মত সহিষ্ণু আর নদীর মত সমর্পণতা নিয়ে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় মনে বেধে রেখেছিলাম। একদিন সকালে বাজার করে ফেরার পথে অনুভব করি শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে। সেইসাথে মাথাটাও ঘুরছে। এসময় বাড়ির কাছে আসতেই নিধির সাথে দেখা।
.
"ভাইয়া, একটা হেল্প করবেন প্লীজ?"
.
"কী হেল্প?"
.
"একটা ছেলে তখন থেকে ফোনে পাগলের মত প্রলাপ বকছে। তাকে একটু ধমক দিন।"
.
"কে সে?"
.
"চিনি না। আননোন নাম্বার।"
.
"ঠিক আছে, ফোনটা দাও আমাকে।"
.
রিসিভার কানে তুলে নিয়ে কয়েকবার ধমকের সুরে কথা বলতেই একটা মেয়ে ওপাশ থেকে নরম সুরে বলল, সরি, কিছু মনে করবেন না। এটা আমার কাজিন ছিল। ও আসলে মানসিক প্রতিবন্ধী। দয়া করে তাকে মাফ করবেন।
.
কন্ঠস্বরটা ভীষণ চেনা লাগছিল। তাই জিজ্ঞেস করি, আপনার নামটা জানতে পারি?
.
"জ্বী, আমি মীরা।"
.
মীরা! বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পিটিয়ে চলেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে বলি, মিরপুরে থাকেন বুঝি?
.
"হ্যা।"
.
আমি আর বিস্ময় এবং আবেগ সামলে রাখতে পারি না। নরম সুরে বলি, কেমন আছো মীরা?
.
ওপাশটা নীরব।
.
আবার বলি, মীরা, ভাল আছো তো?
.
সাথে সাথে লাইন কেটে দেয় মীরা। আমি হতাশ চোখে ফোনের স্ক্রীনের দিকে চেয়ে থাকি। নিধি বলে, মীরা কে?
.
"তোমাকে বলেছিলাম না একটা মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হবার পরও ক্যানসেল হয়ে গিয়েছিল, মীরা হল সেই মেয়ে।"
.
নিধি কিছুক্ষণের জন্য মৌনতায় ডুবে থেকে কন্ঠস্বরে দ্বিধাদ্বন্দ্ব মিশিয়ে বলে, দেখুন, আমার সামনে কোনো ইরা-মীরার নাম উচ্চারণ করবেন না।
.
"মানে?"
.
নিধি উত্তর না দিয়ে ছুটে চলে যায় ঘরের ভেতর। আর আমি অবাক চোখে ওর চলে যাওয়া দেখি।
.
বাড়ি ফিরে কঠিন জ্বরের অস্তিত্ব টের পাই আমি। প্রচন্ড শীতানুভূতি নিয়ে কম্বল গায়ে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। তারপর জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করতেই ঘুম। একসময় চোখ মেলে দেখি মুখের ওপর মামা-মামীর ভ্রু কুঞ্চিত মুখ ভেসে আছে। আবিষ্কার করি আমার মুখের ভেতর থার্মোমিটার গুজে রাখা। মামা থার্মোমিটার বের করে বলেন, জ্বর তো ১০৪ ডিগ্রী!
.
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই অস্পষ্টভাবে অনুভব করি কেউ একজন মাথার কাছে বসে আছে। কে? মীরা? আমি ডাকি, মীরা! কেউ এলজন ইতস্তত করে বলে, ভাইয়া, আমি নিধি।
.
"ও আচ্ছা।"
.
নিধি অনেক কথায় বলতে থাকে। সেই কথাগুলোর সিংহভাগই জ্বরের ঘোর কৃষ্ণগহ্বরের মত শুষে নেয়। একসময় অনুভব করি নিধি পরম মমতায় আমার হাতটি ধরেছে। সে কপালেও হাত রাখলো। পারদের মতো গাঢ় আবেগ প্রসারিত হল তখন।
.
সেদিন রাতে নিধিকে স্বপ্নে দেখলাম। খুবই সাধারণ স্বপ্ন, তবু আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম তাতে। দেখলাম, প্রচন্ড বৃষ্টিতে দুজনে একসাথে বারান্দায় বসে কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ফেলছি। ব্যস, এটুকুই। কিন্তু স্বপ্নটার রোমাঞ্চকর অনুভূতিটা ছিল অবর্ণনীয়।
.
চারদিনের মাথায় জ্বর সারলো আমার। শুরুতেই তখন নিধিকে দেখতে মন চাইলো। আমি বারান্দায় চলে এলাম। কিন্তু নিধিদের বারান্দা সম্পূর্ণ খালি পড়ে থাকতে দেখলাম, একটা আসবাবও সেখানে নেই। পরে যা জানতে পারি তার জন্য আমার প্রস্তুতি ছিল না। নিধির বাবা বদলী হয়ে পুরো পরিবার নিয়ে সিলেট চলে গেছেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল ভীষণ। নিধিকে নিয়ে যে অব্যক্ত অনুভূতি মনের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে ছিল সবই ফিকে হতে শুরু করলো।
.
আজকের আকাশটা শুরু থেকেই মেঘাচ্ছন্ন ছিল। হঠাৎ-ই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামলো। আমি শূন্য দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছি। আর অপেক্ষা করছি কখন পাশের বারান্দায় নিধি আসবে? কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ছাড়বে? যদিও জানি আমার এই অপেক্ষার সুষ্ঠু প্রতিফলন ঘটবে না।
No comments