Header Ads

আকাশটা মেঘনা

ফেসবুক
আকাশটা মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি হবে হবে করেও কেন জানি হচ্ছে না। আমি অধীর আগ্রহ ভরা চোখ দিয়ে ছাদের উত্তর দিকটার এক কোণে দাড়িয়ে এক নয়নে দূরের আকাশে তাকিয়ে আছি। আজ বৃষ্টিটা হওয়া খুব দরকার ছিল। কেন জানিনা আমার মনের কথা বোধহয় দূরের আকাশ পর্যন্ত কোনভাবে পৌছবে না
পানিতে পড়ে যাওয়া সাতার না জানা লোকটাও সূক্ষ্ম খড়কুটো আকড়ে ধরে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করে। আমিও আরও কিছুক্ষন উদ্দেশ্যহীন হাটাহাটি করছি হালকা নীলাভ আস্তরণ পড়া ছাদের বুকে। এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। বৃথা চেষ্টা। হঠাৎ করে কে যেন ডেকে উঠল, 'এইযে শুনছেন?
.
বাতাস যেন কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেছে। আমার চারপাসের বায়ু প্রবাহের প্রতিটি বিন্দুবৃত্ত যেন একটা মায়াবী নারীর কন্ঠস্বর প্রতিফলিত করছে আমার কানে। কি মিষ্টি সে গলা! স্থান কাল ভুলে গিয়ে আমি সেই মায়াবী গলার মেয়েটার কন্ঠের উৎসের সন্ধানে সযত্নে তাকালাম পাসের সুউচ্চ আটতলা বিল্ডিংটার দিকে।
.
কিন্তু না। হতাস হতে হলো। আমার সন্ধানী চোখ জোড়া আরেকবার বুলিয়ে নিলাম সাদা পেইন্টিং বাড়িটার উপর। তখন আবারও সেই ডাক। এবার আর ভুল নয়। একদম উপরের ছাদ থেকে সেই মানবী করুন সুরে আমাকে ডাকছে। আমি তাতে পাত্তা না দিয়ে হা করে তাকিয়ে আছি তার চোখ জোড়ার দিকে।
.
কি মিষ্টি না তার গলা। যেন রুদ্দুর পড়া কোন পড়ন্ত বিকেলের ধূসর আস্তরণ। তার চোখ জোড়া যেন বৃষ্টি শেষে পৃর্ব আকাশে উড়া সাতরঙী কোন রংধনু। তার মুখের উপর বিকেলের হালকা রক্তিম আলোর আভা ফুটে উঠেছে। তাতে তার গালের দুই পাসে লালচে বর্ণের সৃষ্টি হয়েছে। আমি তাতে রামধনুর সাতটি রং খুঁজে বেড়াতে লাগলাম। কতকাল তার গালে রামধনু খুজেছিলাম মনে নেই। তবে একসময় মেয়েটা বলে উঠল,
.
আমার ঘুড়িটা পাচ্ছিনা। একটু খুঁজে দিবেন?
হু। ঘুড়িটা কি বিকেলের তোমার রোদ পোড়া গালের মতন?
.
কি উল্টাপাল্টা বলছেন হু? ওটা হলুদ রঙের।
.
আচ্ছা রংধনুতে কি হলুন রং আছে?
.
মেয়েটা এবার তার দুই চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে, ঠোঁট গোল করে বলল '! আপনি কি আমার সাথে কথা বলছেন?
.
হু। কেন ছাদে কি দুইটা পরী আছে?
.
পরী থাকতে যাবে কেন হু? শুনেন আপনাদের ছাদে আমার ঘুড়িটা পড়েছে। আপনি একটু প্লীজ ওটা আমাকে নিয়ে দিবেন?
.
হ্যা হ্যা। কোথায় যেন পড়ছে? ছাদে।
.
হু। দিন এবার
.
আমি ঘুড়িটা বগলদাবা করে নিয়ে সোজা আমার রুমে চলে আসলাম। এই ঘুড়ি দেওয়া যাবেনা। আমার অনেক কাজ। রুমে ফিরে বালিশের নিচে সযত্নে হলুদ ঘুড়িটা লুকিয়ে রাখলাম।
.
এরপর আমার প্রতিদিনের নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ হয়ে গেল বিকেল বেলা ছাদে কাটানো। তার জন্য আমাকে যথেষ্ট ভুগতে হয়েছে। একটা মাত্র টিউশান করাতাম। সেটাও ছেড়ে দিলাম। এখন আর দুপুরের পর বিছানায় যায় না, যদি ঘুম না ভাঙ্গে বিকেল বেলা? দিনের ওই অংশটা হয়ে গেল আমার সবচেয়ে প্রিয় একটা সময়।
যতই যা কিছু হয়ে যাক। আমাকে কেউ ফেরাতে পারেনা বিকেলর সময়টাতে। এখন আমার আকাশে আমি সাত রং খুজে বেড়াই। কি জানি হয়ত আমার আকাশটাও রঙীন হতে চলেছে। এলোমেলো ভাবনায় মাথা ডুবে থাকে সারাক্ষণ। তাতে ওই মানবীর বর্নিল প্রতীচ্ছবি ছাড়া আমি কিছু খুঁজে পাইনা। সমস্ত মস্তিষ্কচালনা করে চলেছে সেই পগন্ত বিকেলের মেয়েটি। আমি আর আমি নেই। আমি হারিয়ে গেছি তাহাতে। তাহার সাতরঙী মিষ্টি গালের আড়ালে।
.
কিন্তু যার জন্য এত পাগলা ভাবনা তার কোন দেখা নেই। কেন জানিনা সেদিনের পর থেকে যদিও আমি ওই শ্যাওলা পড়া ছাদে যেতে এক মুহূর্ত দেরী করতাম না। কিন্তু আমার সেই কাংখিত মানবী কেন জানি আর আসে নি। আমি প্রতিদিন ঠিক এক জায়গায় দাড়ায়। চোখ থেকে চশমা খুলে ঝাপসা চোখে উপরের আকাশপানে তাকিয়ে থাকি। এবং প্রতিবারই আমার ঝাপসা দুই চোখ ব্যার্থ হয়। সে ওই দূরের আকাশে রামধনু খুঁজে বের করতে পারেনা। আমি আশাহত হই না। বিরস মুখে চশমার কাচ মুছে শেষ বারের মত আবার আকাশপানে তাকাই। তারপর এক পা এক পা ফেলে বদ্ধ রুমের ভেতর বসে হলদে ঘুড়িটার উপর দু ফোঁটা চোখের জল ফেলি।
.
মানুষ যখন পবিত্র ভালবাসার স্পর্শ পায় , তখন সে হাজার চেষ্টা করে হোক সেটা তার নিজের হোক।হোক না সেটা দূরের। তবু তার তো। অপেক্ষা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই।
সময়টা চলে যেতে লাগল যার যার মত করে। দিনের বেলা নিজের কাজে ব্যাস্ত থাকি। সময়টা কোনভাবে কেটো যায়। এদিক এদিক করতে করতে। ব্যাস্ত নাগরীর শত দালানের ফাঁকে আমাকে কেউ মনে রাখে না। আরও দরকারও নেই। আমি একা শহরের যত অলিগলি, ভেজা রাস্তা আর ডাস্টবিনের পাসে থাতা কাকের কর্কশ আর্তনাদ শুনে কাটিয়ে দেই। ধূলোমাখা মলিন মুখ টা ঢাকা পড়ে একসময় সোডিয়াম লাইটের ভাঙ্গা কোন ল্যামপোস্টের হলুদ আলোর নিচে। হলুদ সে আলোর ফাঁকে নিজেকে আরেকবার চিনে নেওয়ার শেষ চেষ্টা চালাই। সঙ্গী তখন আমার উপরের বিশাল কালচে আকাশ আর নিচের কাল পীচ ঢালা রাস্তা।
.
সময়ের পরিবর্তন হলো। কোন এক পড়ন্ত বিকেলে আবারও দেখা পেলাম সেই মেয়ের। একবার ভাবলাম চোখের ভুল নাতো? নাহ। চোখের কোন ভুল সেদিন ছিলনা। আমার কালি পড়া চোখ সেদিন জীবনান্ত হয়ে উঠল। মাথার এলোমেলো ভাবনা গুলো আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আমি সবকিছু পেছনে ফেলে মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
.
এইযে শুনছেন ঘুড়ি চোর?
.
এতদিন কোথায় ছিলে?
.
কেন? আপনার বুঝি আরও চুরি করার সখ? আমার ঘুড়ি কই?
.
নাহ। তোমার চোখের বর্ণীল ভালবাসা চুরি করার সখ!
.
কি? কিছু বললেন?
.
নাহ। এতদিন কই ছিল? ছাদে আস নাই কেন?
.
এতদিন বাইরে ছিলাম।
.
হু। একটা কথা বলি?
.
না।
.
প্লিজ। ভাল কথা
.
বলেন
.
তুমি কি তোমার সাতরঙের সূক্ষ্ম কিছু ছন্নছড়া আবেগের ভাগ আমায় দিবে?
.
কি বললেন?
.
আমি তোমার ছাদে আসতে চাই। কথা বলব একটা
.
হু।
.
অতঃপর আমি তার ছাদে গেলাম। তাকে আরও কাছ থেকে দেখার মত কোন সুখময় স্মৃতিপট আমার জীবনে ছিল কিনা জানি না। কিন্তু তার সবকিছু আমাকে অসম্ভব কাছে টানছে। তাকে বললাম, ' আমরা কি একে অপরের খুব কাছের কেউ হতে পারি?
.
সে কিছু না ভেবে বলে দিল হ্যা। কিন্তু সেদিন আমি ভুল ছিলাম। আসলে সে আমাকে তার মনের খুব ভাল একজন বন্ধুর জায়গাটা দিয়েছে মাত্র। কিন্তু আমি ভুলে যায়নি আমার কাংখিত সেই ভালবাসার কথা।
.
শুরু হলো চারপাসে রেলিংঘেরা আর উপরের বিশাল আকাশটা নিয়ে আমাদের হলদে নতুন এক গল্প। পড়ন্ত সেই বিকেলের মেয়েটি এখন তার দূরত্বসীমা কমিয়েছে। এখন অামি থাকি তার খুব কাছাকাছি। মাঝখানে কেবল অদৃশ্যমান এক অনুভূতি। বিকেলের লালচে আভা তার চুলের ভাজে যখান পড়ে, আমি তাতে হাত ছুইয়ে দেই।
আমাদের মাঝে আছে এখন এক বিশাল নীল আকাশ।
.
আমাদের সময়টা অসম্ভব রকম ভাল কাটতে লাগল। আমি তাকে বেসুরা গলায় গান শোনাই আর তাতে সে তার মায়াবী হাসি যোগ করে। আমরা একসাথে বিকেলের সমটা পার করি। তার জন্য আমি প্রতিদিন বেলুন নিয়ে যাই, আর সে একটা একটা করে ফুঁটো করতে করতো হি হি করে হাসে
সে আমার জন্য আমার প্রিয় সব খাবার নিয়ে আসে, আমি খাই। আর সে মুগ্ধ নয়নে তাকায়। একদিন সাহস করে তার হাতটা ধরলাম। তার হাতে হাত রেখে রক্তিম আকাশের শেষ দৃশ্যটা দেখছি। তাকে আস্তে আস্তে বললাম,
' আমি যদি কোন একজনের সোনালী চুল গুলো নিয়ে ভাবি? সে কি ভাবে? আমি যে খুব করে তার সাথে কথা বলতে চাই। আমার প্রতিটা মুহূর্তকাল যে তাকে নিয়ে ভাবে? আমি যে সবসময় তার আকাশের রঙটা তার সাথে দেখতে চাই'
.
বিনিময়ে নীরবতা। তবুও আমি সন্ধ্যার শেষ আলোকবিন্দু পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তার হাতটা ধরে রইলাম। অখন্ড নীরবতা চারপাসে। আকাশটাও যেন চুপসে গেছে। সে এবার বলল, ' আমার যেতে হবে'
আমি আর বাধা দিলাম না।
ফিরে এলাম নিজের রুমে। পিছনে রেখে এলাম আমার অবাধ্য কিছু ছন্নছাড়া অনুভূতি।
.
এরপর আমার আর সেদিন স্বাভাবিক ঘুম হলো না। অনেক অনেক স্বপ্ন দেখতে লাগলাম তাকে নিয়ে। কত শত বিবর্জিত অনুভূতি। সব যেন আজকে কোন এক উৎসবে মেতেছে। ভালবাসার উৎসবে।
পরেরেদিন এক পা এক পা করে এগিয়ে চলেছি তার দিকে। পা যেন আমার চলতে চায়না। তবু কোন এক অদ্ভুদ কারনে আমার মন আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে সেই মিষ্টি সুরেলা মানবীর ডাকের দিকে। সেই অগ্রাহ করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেয়নি। অবাধ্য সাহস নিয়ে তার সামনে গেলাম এক চিলত হাসি নিয়ে। সে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আমার দিকে। চোখে তার সহস্র বিষ্ময়। আমি ঠোঁটের কোণে এক চিমটি হাসি নিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে ধরলাম তার সেই পুরোনো হলদে রাঙানো ঘুড়িটা। ঘুড়ির বুকে গাঢ় নীল কালিতে লিখে দিলাম,
.
' জাগ্রত কিংবা ঘুমন্ত। দেখি এক মানবীর প্রতিচ্ছবি। তুমি কি সে?
শত রঙের মাঝে চিনে নিয়েছি তোমার সেই উজ্জ্বল নক্ষত্র।
অবাধ্য সাহসে আমার ভালবাসার পুরো পৃথীবি। তাতে তুমি শেষ
বিকেলের সে অবাধ্য নারী। যাকে চিনে নিতে বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি।
রাখবে কি তুমি তোমার হাত অবাধ্য সেই ছন্নছড়ার হাতে?
.
আমার হাতের ভেতর কোন স্পর্শিনীর হাত অনুভব করলাম।চোখে তার ভালবাসার দৃষ্টি।সে ঘুম ঘুম চোখে তার সাতরঙা রংধনু নিয়ে আমার বুকে মুখটা চেপে রাখল।

No comments

Powered by Blogger.