Header Ads

বসন্তী বাতাস

জানালা টা খোলা , বাইরের বাসন্তী বাতাস আসছে। সাথে হালকা পানির আবছায়া এক অনুভূতি। আদিত্য বুঝতে পারে, বৃষ্টি আসবে। তার মনটা খুশিতে ভরে ওঠলো। আহা! কতদিন পর বৃষ্টিতে ভিজবে সে !
হলের ছাদে যখন পৌছুল, ততক্ষণে বারিধারা অবিরাম বর্ষিত হতে শুরু করেছে। আদিত্য ঘোলাটে চোখে দেখতে পাচ্ছে, সামনের জলাশয়ে পানির ফোঁটাগুলো যেন খেলায় মেতে উঠেছে। সে আনমনে বলে উঠলো,,
_" মাতলো রঙের হাজার ছোঁয়ায় শাপলা ফুলের মন
সুর তুলে ওই ভিজছে দূরে শ্যামল ছায়ার বন। "
আদিত্য ছোটবেলা থেকেই কাব্যিক। সেই শিশু শ্রেণীতে থাকতেই বনফুল পড়তো সে। আর সে ত নিজেই কবি ছিল । তবে প্রফেশনাল নয়। কি বলে ওকে, ও হ্যাঁ। শখের কবি। কিন্তু এখন আর সে কবি নয়। কবিতা তার হৃদয় ছিল, কিন্তু জীবন নয়। হৃদয় ছাড়াও আজকাল হৃদয়হীন মানুষেরা বেঁচে আছে, ভাল করেই বেঁচে আছে।
২ . ঘুমের মাঝেই মুখে বৃষ্টির ছিটা আসতেই স্পর্শিয়া জেগে ওঠে। ওহ!! বৃষ্টি। কতদিন বৃষ্টি দেখে না সে। পরক্ষণেই মনে হলো,, আদিত্য ও নিশ্চয়ই বৃষ্টিতে ভিজছে। স্পর্শিয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কতদিন ওকে বলেছিল, একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতে। আদিত্য ওকে না করে দিতো। বলতো, একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজলে মনও নাকি একসঙ্গে বাঁধা পড়ে। ওর খুব রাগ হতো ; একসাথে না হয় পড়লোই বাঁধা, তাতে কী হয়েছে? আদিত্য কী অন্য কোন ইয়া মোটা কুটনী মেয়েকে পছন্দ করে রেখেছে? যদি তাই হয়, তাহলে ওই মেয়ে আর আদিত্য দুইজনকেই সে বিষ খাইয়ে মারবে।
স্পর্শিয়া ছাদের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। এতক্ষণ কী সব আবোলতাবোল ভাবছিলো সে? আদিত্য কখনো কখনো আনমনে মেয়েদের দিকে তাকালেও তাতে সে কখনো খারাপ কিছু দেখেনি। ধূর! বৃষ্টি কী তার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে? সে দৌড়ে গিয়ে গেটটা লাগিয়ে এলো। তারপর ছাদে শুয়ে পড়লো চিৎ হয়ে। আশেপাশে তাদের তিনতলা বাড়িই সবচেয়ে উচুঁ, তাই কারও দেখে ফেলার ভয় নেই। ইশ! যদি সেও কবি হতো! খুব কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা, আদিত্য কী কবিতা লেখা আর শুরু করবে না?
৩.
বাংলা ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়েই স্পর্শিয়া আদিত্যকে দেখতে পেল। হাতে রুমাল, মেয়েদের মত কাজ করা। সম্ভবত ঠাণ্ডা লাগিয়েছে।
-" কী খবর, " আদিত্যের রুমালের দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল সে।
-" ভাল লাগছে না। প্রচন্ড সর্দি লেগে আছে। চলো, একটু ' ভ্যান ভ্রমণ ' করি, পরে এক কাপ চা খাব কোথাও। "
আদিত্য আর স্পর্শিয়া পাশাপাশি বসে। স্পর্শিয়ার নাকে একটা মিস্টি গন্ধ ভেসে এলো। এখন এই ভ্যান গাড়িতে ফুল কোথা থেকে আসবে?
-' আদিত্য "
-" হুম? "
হুম বলল ঠিক আছে, তবে ওর চোখ চারিদিকে প্রকৃতির রুপসুধা পান করছে। আদিত্যকে এই মুহূর্তে খুবই ছোট্ট বাচ্চাদের মত লাগছে, যে নতুন কোন জায়গায় এসে সব কিছু অবাক নেত্রে অবলোকন করছে। স্পর্শিয়ার চোখের কোণে জল এসে গেল। এত সহজ সরল একটা ছেলের প্রেমে সে কীভাবে পড়লো? ও আদিত্যের শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছল। তবুও ওর কোন হুশ নেই।
- "এই আদিত্য। "
-" কি? "
-" একটা গান শোনাও না। "
-" আদিত্য. এইবারে ওর দিকে তাকাল। মুখে হাসি। তারপর গান ধরলো, " বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান ......."
ভ্যানওয়ালা মামা ভ্যান থামিয়ে অবাক হয়ে ওর গান শুনতে লাগল। অর্ধেক গান গেয়েই ওর থেমে যেতে হলো। স্পর্শিয়া আবার কান্না শুরু করে দিয়েছে। এত করুন সুর সে সহ্য করতে পারেনি।
-' আরে পাগলী কাঁদে কেন? সবাই ত হাসবে! এই নাও বকুল ফুলের মালা। "
যদিও আশেপাশে তেমন লোক নেই। শুধু ভ্যানওয়ালা মামা ছাড়া।
-" তুমি এত কষ্টের গান কেন গাও? আর কখখনো গাইবে না এই গান। " বলেই আবার ফিচকে কান্না শুরু করলো সে। ভ্যানওয়ালা মামা রেগে রেগে ভ্যান চালাচ্ছে । মিয়াভাই কত্ত সুন্দর করে গান গাইতাছিল! আর এই পাগল ছেমরির কী হইসে, গান শুইন্না কাইন্দা দিল! পুরা গান ও শুনতে দিল না। যত্তসব ..!
৪. পুকুরের ঠাণ্ডা জলে পা ডুবিয়ে স্পর্শিয়া বসে বাদাম চিবুচ্ছে। আর আদিত্য কবিতা লেখার চেষ্টায় লিপ্ত। মাঝে মাঝে তার কপালেও কয়েকটা বাদাম জুটেছে। কবিতা নিয়ে সে খুব চিন্তিত। গত বছর তার মা মারা যাবার পর থেকে সে আর কবিতা লিখতে পারছে না। অনেকেই বলেছে অনেক কিছু করতে, এমনকি তার বাবাও সব দুঃখ ভুলে তাকে বলেছে আবারো কবিতা লিখতে। কিন্ত দুলাইন লেখার পর মনে হয়, তার মাথা খালি হয়ে গেছে।। তাকে দিয়ে আর কবিতা লেখা হবেনা।
সে নিজেও আর লেখার ইচ্ছা করেনি ,কিন্তু স্পর্শিয়ার জন্য মাঝে মধ্যে লিখতে মন চায়। মেয়েটা বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ। তার সাথেই যা একটু ঘুরাঘুরি। নয়তো অন্য কোন মেয়ের সাথেও ওর দোস্তি নেই। ওকে খুশী করার জন্যও ত কবিতা লেখা উচিত। কিন্তু,
-" আদিত্য, তুমি কী আর কবিতা লিখতে পারবে না? "
আদি মন খারাপ করে ফেলল। প্রত্যাশার চাপ সে আর বইতে পারছে না। তার সব কাব্য প্রতিভা কে যেন ছিনিয়ে নিয়েছে।
স্পর্শিয়া বুঝতে পারল, কথাটা বলে সে ভুল করেছে। প্রসঙ্গ বদলিয়ে বলল
- " আদিত্য, মা বলে কী জান? আমাদের বিয়ে নাকি এক বছর ও টিকবে না। আমরা দুজনেই নাকি রামগড়ুরের ছানা। হাসতে মোদের মানা। "
-" তোমার বেলায় তা কিঞ্চিত সত্যি। কিন্তু আমি ত যথেষ্ট হাসিখুশি। "
-" কী! এত বড় কথা? " স্পর্শিয়া কী করবে ভেবে পেল না। রেগে এক ধাক্কায় ওকে হলের পুকুরে ফেলে দিল।
তারপর দেখে, আদিত্য উধাও! হায় হায়! ওকি সাতার জানে? স্পর্শিয়া চিৎকার করে আদিত্যকে ডাক দিল।
এইবার ওর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেল। ওও ত সাতার জানে না। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিল, নিজে মরে হলেও আদিত্যকে বাঁচাতে হবে।
স্পর্শিয়া লাফ দিবে, এমন সময় আদিত্য ভুস করে জলের নিচ থেকে উঠে এলো।
-' আহা, জলের নিচটা কত ঠাণ্ডা! কত দিন পর এই পুকুরে নামলাম। ধন্যবাদ স্পর্শিয়া। "
ঘোলাটে চোখে সে দেখতে পায়, স্পর্শিয়ার চোখ দিয়েও অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। সে বোধহয় ভয় পেয়েছে। বেচারি!
৫. চাঁদটা মাঝ রাত্রিতে মাঝ গগনে জোৎস্না ঝরাচ্ছে অঝোর ধারায়। বাতাসে কচি আমের ঘ্রাণ আসছে।
আদিত্য ছাদের ধারে বসে আছে। মনের দুঃখগুলো গা বেয়ে জোৎস্নার সাথে পড়ে যাচ্ছে। ওর মন ধীরে ধীরে খুশি খুশি হয়ে যাচ্ছে। অনেক দিন পর আজ সে একটা বিষয়ের সমাধান পেয়েছে। ও স্পর্শিয়ার মোবাইলে কল দিল, যদিও সচরাচর তারা মোবাইলে কথা বলে না। তবুও ওর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে।
-" হ্যালো, স্পর্শিয়া। "
স্পর্শিয়া বসে বসে বই পড়ছিল। কল আসতেই মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে, আদি কল দিয়েছে। ও প্রচন্ড খুশিতে বাকহারা হয়ে গেল। কতদিন পর আদিত্য কল দিয়েছে তাকে। নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু বলতে। আচ্ছা, সে বিশেষ কী বলবে??
-" স্পর্শিয়া, ভাল আছ? একটু আগে বুঝতে পেরেছি,, কেন আমি এখন আর কবিতা লিখতে পারি না। "
ওপাশে কান্নার আওয়াজ, বেচারি স্পর্শিয়া আবারো কাঁদতে শুরু করেছে । আদিত্য বলতে থাকে
-" মা-ই ছিল আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আমার জীবন মরণ হাসিকান্না সব মাকে নিয়েই ছিল। আমার কবিতার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ শ্রোতা ছিল মা। তার কাছেই আমি কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পাই । মা চলে গেছে, সাথে সাথে আমার ভিতরের কবিও মরে গেছে। আমি আর কখোনোই কবিতা লিখতে পারব না স্পর্শিয়া। এতে আমার দুঃখ নেই। কিন্ত, আমার মা যে নেই স্পর্শিয়া! আমার মাকে কোথায় পাব আমি? আকাশের ওই মেঘের দেশে কী মাকে পাব স্পর্শিয়া? আমি এখন কী করবো?
মেঘের দেশে যাব! হ্যাঁ! ওইটাই করতে হবে আমাকে। তুমি কী আমার সাথে যাবে স্পর্শিয়া? যাবে আমার সাথে মেঘেদের পিছু পিছু? "
দু পাশের দুজন কাঁদছে। একজন নিজের শ্রেষ্ঠতম প্রিয় মানুষের জন্য কাঁদছে। আরেকজন আবেশ প্রক্রিয়ায় ক্রন্দনে বাধ্য হয়ে কাঁদছে। মেঘেদের পিছু নিলে এখনই তাদের যেতে হবে। মেঘেরা তাদের জন্য বসে নেই। তারা ছুটে চলেছে দেশ থেকে দেশান্তর, তাদের যে কোন ছুটি নেই।

No comments

Powered by Blogger.