একজন বাবা
ফারুক মিয়া একজন সাধারন মানুষ.. ছোট একটা চাকুরী করে সংসার চালায়.. সংসারে আপাতত কেউ নেই.. সে আর তার স্ত্রী.. কিন্তু তার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট তাই কিছু দিন পরই কেউ আসবে...
কিছুদিন পর তাদের ঘর আলো করে আসল একটি ফুটফুটে মেয়ে... ফারুক যদিও ছেলে চেয়েছিল কিন্তু মেয়ে হওয়াতেও সে অসুন্তষ্ট নয়...
সে তার স্ত্রীকে বলে দিল... আমরা আর সন্তান নিব না...এই মেয়েকেই আমি এমন ভাবে গড়ে তুলব যেন সে আমার মুখ উজ্জ্বল করে....
...
ফারুক তার মেয়ের নাম রাখল ""ফারিয়া"".... ফারিয়া যখন একেবারেই ছোট তখন তার নানা খরচ ""দুধ খাওয়ানো,, তেল,, আর কত কিছু"" এখন ফারিয়ার মা তো ঘরের কাজ করতে পারত না... ফারুক খুব বেশি টাকা বেতন পেত না.... ফারুক ঘরের কাজ করার জন্য একজন বুয়া রাখল... আর প্রতিদিন ঘরে ভাল রান্না হত। কিন্তু সেটা ফারিয়ার মায়ের জন্য... কারন তাকে ভাল ভাল খেতে হত... আর ফারুক নিজে দিনে একবেলা খেয়েও কাটিয়ে দিত... কিন্তু মেয়ে ফারিয়ার কোন কিছুতে কমতি রাখে নাই...
না খেয়েও কাজ করত ফারুক....
..
যাই হোক ফারিয়া আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল...ফারিয়ার মুখে প্রথম ডাক ছিল "বাবা"... ফারুক প্রথম প্রথম যখন বাবা ডাক শুনত তখন আবেগে কেদে দিত...
...
ফারিয়া হাটতে শিখল... এখন ফারিয়াকে স্কুলে দিতে হবে... এলাকায় ২টা স্কুল... একটা অনেক ভাল..খুব ভাল পড়াশুনা হয়..আর আরেকটা সরকারি... অইটাতে তেমন ভাল পড়াশুনা হয় না....
ফারুক নিজের মেয়েকে ভাল স্কুলেই দিল...
ফারিয়ার মা::: অত ভাল স্কুলে দিলেন কেন?? অইটার খরচ এখন অনেক বেশি
ফারুক:: এখন থেকে রাতে ভাত খাব না... ৩০ দিনে রাতে খাওয়ার টাকা জমে যা হবে... তা দিয়ে আমার মেয়ে স্কুলে পড়বে...
..
ফারুক দের ঘরের খাওয়া দাওয়া একটু কম করে করলেও কিংবা খারাপ খেলেও... মেয়েকে সে অই স্কুলেই পড়াবে...কিন্তু ফারিয়াকে সে কখনোই খারাপ খেতে দিত না... ফারিয়ার পছন্দের ডিম প্রতিদিন দিত...
....
কিছুদিন কেটে গেল....
....
একদিন ফারিয়া তার বাবার কাছে এসে বলছে...
.
ফারিয়া:: আব্বু আব্বু ওরা না টিফিনে বিস্কুট,চিপস খায়..আমারো খেতে ইচ্ছা করে...
ফারুক:: (মেয়ের মুখে এই কথা শুনে ফারুকের ভিতরটা কেপে উঠল) (সে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল আর বলল) তুমিও আজকে থেকে খাবে...
ফারিয়া::: সত্যি আব্বু??
ফারুক:: হম
(এই বলে ফারুক তার পকেট থেকে ১০ টাকা বের করে মেয়ের হাতে দেয়)
(ফারিয়া তো রাজ্যর খুশি) (সে টাকা নিয়ে চলে গেল)
ফারিয়ার মা::: এখন প্রতিদিন মেয়েকে টাকা দিবেন কিভাবে?
ফারুক::: এতদিন গাড়ি দিয়ে অফিসে যেতাম... আজ থেকে না হয় হেটেই যাব....
(এরপর থেকে প্রতিদিন ফারুক সকাল ৬ টায় বাসা থেকে বের হয়ে যায়...যাতে সে ৮ টার মধ্যে পৌছে যায়)
এভাবেই চলছিল.....
ফারিয়া বড় হচ্ছিল.....
ফারুক তার মেয়ের সব চাহিদা পুরন করত... নিজে কস্ট করে....
ফারিয়া এখন হাই স্কুলে ঊঠেছে....
এখন তার চাহিদা আর বেড়েছে....
ফারুকের বেতন কিছুটা বাড়লেও... তার পরিবারের তুলনায় কম...
ফারিয়া হাই স্কুলে গেল... এখন তার অনেক চাহিদা... স্কুলের খরচ তো আছেই... বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যেত....
ফারুক কোনদিন না করতো না,,, যেভাবেই হোক টাকা যোগার করে মেয়েকে দিত...
ফারিয়া আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে.... জে.এস.সি পরিক্ষার আগে....
ফারিয়া:: আব্বু সামনে তো পরিক্ষা...
ফারুক:: হম কি হয়েছে মা?
ফারিয়া: আমি ইংরেজিতে কাচা...আমার বান্ধবিরা একটা স্যারের কাছে পড়ে...আমিও পড়তে চাই
ফারুক::: পড়বি সমস্যা কি??
ফারিয়া:: বেতনটা একটু বেশি
ফারুক::: মাত্র ২ মাসের ব্যাপার তো হয়ে যাবে... তুই চিন্তা করিস না মা... হয়ে যাবে... তুই ভাল করে পড়াশুনা কর
(ফারিয়া খুশিতে নাচতে নাচতে রুমে চলে গেল)
ফারুক এই দুমাস রাতের ২-৩ টা অবদি ওওভারটাইম করে ফারিয়ার টিচারের টাকা যোগার করে...
২ মাস পর ফারুক অসুস্থ হয়ে যায়...
কিন্তু সে সবার সামনে ভাল থাকার অভিনয় করে.... কারন এখন ডাক্তারের কাছে গেলে অনেক টাকা লাগবে....
তাই সে চুপ করে থাকে....ফারিয়া অন্যদিকে ক্লাস ৯ এ উঠে গেল...
দিন চলছে তো চলছেই....
ফারুক তার মোবাইলে বেশি টাকা ভরে না... মাঝে মাঝে ভরে....একদিন সে ৫০ টাকা ভরেছে... ভাবছে এইটা দিয়ে সারামাস কাটাবে...
হঠাত ফারিয়া আসে বলে
ফারিয়া:: আব্বু তুমার মোবাইলে টাকা আছে?? আমার একটা বান্ধবিকে ফোন করতে হবে..
ফারুক:: হে রে মা.. এই নে
(ফারিয়া ফোনটা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল)
কিছুক্ষন পর এসে বলে
ফারিয়া:: আব্বু সব টাকা শেষ হয়ে গেছে... সরি
ফারুক:: যাক যাক... তোর কাজ হয়েছে তো...
ফারিয়া;:: হম হয়েছে...
(ফারুক কাজের ফাকে রুটি-কলা খেত... সেইটা ৫ দিন না খেয়ে সেই টাকা আবার মোবাইলে ভরলো)
....
ফারিয়ার এস.এস.সি পরিক্ষা শেষ...
রেজাল্ট দিয়ে দিল...
সে A+ পেয়েছে....
ফারুক খুব খুশি.........
ফারুক::: বল মা তু কি চাস??? আমি দিব
ফারিয়া::: দিবে তো??
ফারুক:: হম যা চাইবি তাই দিব
ফারিয়া:: আমাকে একটা মোবাইল দাও
ফারুক:: (হাসি মুখে) পেয়ে যাবি
ফারিয়া:: আব্বু তুমি গ্রেট :: লাভ ইউ
(ফারিয়া চলে গেল)
....
ফারিয়ার মা::: মোবাইল কি চকলেট নাকি যে চাইলেই কেনা যায়।।। অনেক দাম
ফারুক:: আমার মেয়ে যদি লেপটপ চাইতো তবুও আমি দিতাম... আর এইটা তো শুধু মোবাইল...
(তারপর ফারুক সারাদিন অফিস করে আসার পর... রাতের বেলায় পাহারাদারের একটা চাকুরি নিলেন একমাসে জন্য)
যেটার বেতন ১৫০০০ টাকা....
সকাল ৮-রাত ৮ টা অবদি একটা চাকুরি... আবার রাত ১১ টা থেকে সকাল ৫ টা অবদি আরেকটা.....
মাস শেষে ১৫০০০ টাকা এনে মেয়েকে দিয়ে বলল ""এই নে তুই পছন্দমত কিনে নিস"""
ফারিয়া টাকা হাতে পেয়ে যেন আকাশে উড়ছে...
যাই হোক তারপর ফারিয়া কলেজে গেল।।।
...
একদিন ফারুককে একজন এলাকার মুরুব্বি বলছে...
মুরুব্বি:: ফারুক ভাই আপনার মেয়েকে তো বিভিন্ন যায়গায় দেখা যায়
ফারুক:: বিভিন্ন যায়গায় মানে??
মুরুব্বি:: মেয়ে বড় হইছে... একটু খেয়াল রাইখেন..
ফারুক:: কি দেখছ তুমি??
মুরুব্বি:: ফারুককে সব বলল...
(ফারুক বাসায় এসে ফারিয়াকে ডাকল)
ফারুক:: মা রে আমরা গরিব... গরিবদের নিয়ে কিন্তু সবাই খেলে..কিন্তু আমাদের সেই ফাদে পা দেয়া উচিত না
ফারিয়া:: এগুলা বলছো কেন আব্বু??
ফারুক:: তুই বড় হয়েছিস... নিজের ভাল বুঝিস...এমন কিছু করিস না... যেটা আমি সহ্য করতে পারব না...
ফারিয়া::: তুমার কস্টের মুল্য দিতে আমি জানি আব্বু... তুমি নিশ চিনতে থাক... তুমার মেয়ে এমন কিছু করবে না....
ফারুক :: খুব ভাল লাগছে রে মা.. যা তুই যা।।।
(এভাবেই চলছিল)
তারপর একদিন অনেক বড় ঘর থেকে ফারিয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এলো...
ফারুক রাজি হয়ে গেল...
ফারিয়ার অমত... সে এখন বিয়ে করবে না।।। পড়াশুনা করবে...
ফারুক:: আরে মা... ওরা তোকে পড়তে দিবে... বিয়ের পর তুই পড়তে পারবি...
ফারিয়া:: তবুও আব্বু... থাক না এখন
ফারুক:: আমাদের মত গরিবের মেয়ের জন্য এর চাইতে ভাল ঘর আর আসবে না...
ফারিয়া:: আব্বু প্লিয
ফারুক:: আমি যা বলেছি তাই.... হবে (রেগে)
....
সকাল হলো....
রাতে মেয়েকে ধমক দিয়েছে বলে সারারাত ভাল করে ঘুম হয় নি ফারুকের... তাই সকালেই চলে গেল মেয়ের রুমে...
অনেকক্ষন দরজা নক করছে কিন্তু খুলছে না...
হয়ত ঘুমাচ্ছে...
(তাই ফারুক চলে গেল.. রাস্তা দিয়ে অফিসে যাওয়ার সময় সে দেখল ""ফারিয়ার রুমের পিছন দিকে দেয়াল ভাংগা""
ফারুক আবার বাসায় আসল...
এসে ফারিয়ার রুমের দরজা ভেংগে রুমে ডুকল....
ডুকে দেখে কেউ নেই... শুধু একটা চিঠি...
চিঠিতে লিখা """আমি রাজনকে ছাড়া আর কারো হতে পারব না..ভয়ে কথাটা তুমাকে বলতে পারলাম না.. আমাকে আর খুইজো না""
.....
ফারুক নিস্তব্ধ হয়ে গেল....
ফারিয়ার মা ফারিয়ার বান্ধবিদের খবর দিল
তারা বলল ""জে.এস.সি. পরিক্ষার দু মাস আগে ইংরেজি স্যারের কোচিং থেকে ওদের রিলেশন শুরু...তারপর রাজনের জন্যই মোবাইল কেনা ইত্যাদি """
এসব শুনে ফারুকের চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ছে....কিচ্ছু বলছে না সে... তার জবান বন্ধ হয়ে গেছে....
এলাকার মানুষজন তাদের অপমান করা শুরু করল...
ফারুকের শরির খারাপ হয়ে গেল...
সে এখন আর কাজ করতে পারে না....
অনেক দিন কেটে গেল...
একদিন ফারুক রাস্তায় বের হল...
এলাকার কিছু বখাটে ছেলে ফারুককে বলছে...
বখাটে::: আংকেল... এতদিন তো মেয়েরে বোরকা পড়াইয়া রাখছেন... চেহারাও দেখতে পারি নাই.. আজকে তো সব দেখে ফেললাম
ফারুক:: কি বলতে চাও.?
বখাটে::: ভিডিওটা দেখবেন নাকি??
(ফারুকের বুঝতে বাকি রইলো না)
তার চোখ থেকে পানি বের হয়ে গেল... সে সেখান থেকে চলে এলো....
.....
তারপর অনেকদিন পর ফারুক জানতে পারল """আসলে রাজন নামের ছেলেটি ভাল ছিল না... সে এভাবেই মেয়েদের পটিয়ে ভিডিও বানিয়ে টাকা ইনকাম করে"""
কিন্তু ফারিয়া এখন কোথায়?? হয়ত সে আত্মহত্যা করেছে কিংবা করে নাই....
কিন্তু এই বুড়ো ফারুকের কি দোষ ছিল???
সে শুধু তার মেয়েকে ভালবেসেছিল এবং নিজের মেয়েকে ভাল একটা যায়গায় বিয়ে দিতে চেয়েছিল....
তার ভালবাসার পরিনাম হল ভয়ানক...
দু:খে কস্টে শোকে কিছুদিন পর ঘুমের মধ্যেই ফারুক মারা গেল.....
.....
পৃথিবী এমনি.... """আসল ভালবাসা কেউ চিনে না""
No comments